ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন বিজেপি দীর্ঘ ২৭ বছর পর দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে এক ঐতিহাসিক জয় পেয়েছে। এমনটিই জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। এই জয়ের মাধ্যমে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজধানীর ক্ষমতায় থাকা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি (আপ) এবার ধরাশায়ী হলো পদ্ম-শিবিরের কাছে।
এদিকে বিজেপির জয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একে 'উন্নয়ন ও সুশাসনের জয়' বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে, হার স্বীকার করে কেজরিওয়াল বলেছেন, 'জনাদেশ মেনে নিচ্ছি, বিজেপিকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।'
কেজরিওয়াল হার স্বীকার করে বলেন, 'আমরা গত ১০ বছরে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিকাঠামো ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন করেছি। দিল্লির মানুষ এখন অন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা গঠনমূলক বিরোধী দল হিসেবে কাজ করব।' এদিকে বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী অতিশী সিং বলেছেন, 'আমরা জনগণের রায় মেনে নিচ্ছি। তবে বিজেপির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলবে।'
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্থান টাইমসের এক তথ্য অনুযায়ী বিজেপি দিল্লির ৫০টি আসনে এগিয়ে রয়েছে, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় আসনের চেয়ে ১৪টি বেশি। অন্যদিকে, আম আদমি পার্টি মাত্র ২০টি আসনে এগিয়ে। এদিকে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন কংগ্রেসের ঝুলিতে নেই একটিও আসন। এবারই প্রথম নয়াদিল্লি আসন থেকে পরাজিত হলেন কেজরিওয়াল। এ আসনে ২০১৩ সালে দিল্লির তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতকে হারিয়ে নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন আপ প্রধান। এক দশকের ব্যবধানে সেই একই আসনে তাকে হারতে হলো।
কী কারণে আপ-এর পরাজয়?
ভারতের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী এক গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যে দল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে ক্ষমতায় আসে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে মানুষ ক্ষমা করে না। কেজরিওয়াল-সহ আপের একাধিক সদস্য, এমনকি মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ মানুষ ভাল চোখে নেয়নি।
তিনি জানিয়েছেন, কেজরিওয়াল সরকারের মূল শক্তি ছিল প্রাইমারি স্কুল, মহল্লা ক্লিনিকের মতো জনপরিষেবার প্রসার। আপ ক্ষমতায় আসার পর প্রাথমিক ভাবে জনপরিষেবায় উন্নতি করলেও পরবর্তীকালে সেই পরিকাঠামোর অবনতি হয়। এর ফলও ইভিএমে পড়তে পারে।
বিশ্বনাথ চক্রবর্তী মনে করেন, ''মোদি-সরকারের এবছরের বাজেট এবং মধ্যবিত্তদের কর ছাড়ের সুফল পেতে পারে বিজেপি। অন্যদিকে, কংগ্রেস এবং আপ সরাসরি লড়াইয়ের কারণে সংখ্যালঘু ভোট কাটাকাটি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে, আপের ভোট কংগ্রেসে যেতে পারে।"
এর আগে এক্সিট পোলগুলোর জরিপ দাবি করছিলো যে বিজেপি এবার দিল্লির ক্ষমতা দখল করতে চলছে। যদিও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জাদ মাহমুদ বুথ ফেরত সমীক্ষা সম্পর্কে সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, "ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক্সিট পোলের কোনো নিশ্চয়তা নেই। ২০২৪-এর লোকসভা ভোট-সহ একাধিক নির্বাচনের ফলাফল তার প্রমাণ। আমাদের শনিবার দিনটা অপেক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। তবে একথা অনস্বীকার্য যে দু'দফায় ক্ষমায় থাকার পর আপের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া থাকা স্বাভাবিক।''
এদিকে আপ-এর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকেই হেরেছেন। সৌরভ ভারদ্বাজ, সত্যেন্দ্র জৈন ও মণীশ সিসোদিয়া নিজেদের আসন ধরে রাখতে পারেননি। এ ফলাফল দিল্লির রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ২০১৫ ও ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কার্যত ঝড় তুলেছিল আম আদমি পার্টি। কিন্তু এবার সেই সমর্থন ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। বিশ্লেষকদের মতে, আপের পতনের পেছনে কয়েকটি বড় কারণ কাজ করেছে।
প্রথমত, আম আদমি পার্টির প্রধান ভিত্তি ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণি। কিন্তু গত কয়েক বছরে তাদের নীতিগুলো মূলত নিম্নবিত্তদের ওপর কেন্দ্রীভূত হয়েছে। ২০২২ সালের 'পিপল রিসার্চ অব ইন্ডিয়াস কনজিউমার ইকোনমি'র রিপোর্ট অনুযায়ী, দিল্লির ৬৭ শতাংশ নাগরিকই মধ্যবিত্ত। কিন্তু তাদের জন্য আপের বিশেষ কোনো উদ্যোগ ছিল না। বিপরীতে, বিজেপি মধ্যবিত্তদের কর ছাড়, ব্যবসায়িক সুবিধা এবং নারীদের জন্য মাসিক ভাতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির অভিযোগ আপের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। একসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতেই দলটি আত্মপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে তাদেরই শীর্ষ নেতারা দুর্নীতির অভিযোগে জেলে গিয়েছেন। কেজরিওয়াল নিজে আবগারি দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জেলে ছিলেন। এর আগে মণীশ সিসোদিয়া ও সত্যেন্দ্র জৈনের মতো হেভিওয়েট নেতারা কারাবন্দি হন। এতে দলের প্রতি জনসমর্থন অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে পড়ে।
তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া আপের বিরুদ্ধে গেছে। ২০১৩ সাল থেকে দিল্লিতে আপের একচ্ছত্র আধিপত্য চলছিলো। একদলীয় শাসনে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়, যা এবারের নির্বাচনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন এলাকায় অভিযোগ ওঠে, বিধায়কেরা নিয়মিত এলাকায় যান না, জনসাধারণের সমস্যা নিয়ে ভাবেন না। এ সুযোগটাই নিয়েছে বিজেপি।
চতুর্থত, বিজেপির প্রচার এবং সংগঠনের শক্তি। দিল্লির অবকাঠামোগত সমস্যা, বিশেষ করে রাস্তা সংস্কার নিয়ে বিজেপি লাগাতার প্রচার চালিয়েছে। দিল্লির পুরসভা (পৌরসভা) আপের দখলে থাকলেও রাস্তার দুরবস্থা নিয়ে তারা বিজেপিকে দোষারোপ করতে পারেনি। অপরদিকে, বিজেপি দাবি করেছে, তারা ক্ষমতায় এলে দিল্লির পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। কেন্দ্রের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পকেও তারা প্রচারের হাতিয়ার বানিয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ২০২০ সালের নির্বাচনে আপ-এর দখলে ছিলো ৬২টি সিট। বিজেপি কে রীতিমত পর্যুদস্ত করে আপ। ৫৩ শতাংশের বেশি ভোট পায় তারা। সেসময় কংগ্রেস অবশ্য নিজেদের খাতাই খুলতে পারেনি। কিন্তু এই নির্বাচনের আগে আপের বিরুদ্ধে ক্রমাগত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আসছিলো বিজেপি। এমনকি জেলেও যেতে হয়েছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালসহ একাধিক আপ নেতাকে।
thebgbd.com/NA