ঢাকা | বঙ্গাব্দ

কোন দিকে ইউক্রেন সঙ্কট?

ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে নীতি পরিবর্তন করাতেই ‘বিপদ’ বৃদ্ধি পায় ইউক্রেনের। ট্রাম্পের ‘সমঝোতা’ প্রস্তাবে রাজি নন জেলেনস্কি।
  • অনলাইন ডেস্ক | ০২ মার্চ, ২০২৫
কোন দিকে ইউক্রেন সঙ্কট? ট্রাম্প ও জেলেনস্কির বৈঠক।

হাসি মুখেই হোয়াইট হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্প। অপেক্ষায় ছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির জন্য। তিনি এলেন, করমর্দন করে একসঙ্গে প্রবেশ করলেন বিখ্যাত সাদা বাড়িতে! তখন কে জানতো, ওই হাসি কয়েক মিনিট পরেই উধাও হবে! দুই রাষ্ট্রনেতা জড়িয়ে পড়বেন তর্কাতর্কিতে! ওভাল অফিসে ট্রাম্প-জেলেনস্কির প্রকাশ্য বিতণ্ডার পর বিশ্ব রাজনীতিও ভাগাভাগি। ট্রাম্প-জেলেনস্কির বাগ্‌যুদ্ধ কি আদৌ ভাল হল ইউক্রেনের জন্য? ইউক্রেনপন্থী অনেকেই চিন্তিত সে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে!


প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্প দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন নীতিতে কিছুটা বদল দেখা যায়। ইউক্রেনকে দেওয়া সামরিক সাহায্য কাটছাঁট করে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের আপত্তি এড়িয়ে সৌদি আরবে যুদ্ধবিরতির জন্য রুশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ট্রাম্প সরকারের কর্মকর্তারা। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের জন্য একপ্রকার জেলেনস্কিকেই দায়ী করেন ট্রাম্প। এরপরই প্রকাশ্যে আসে ট্রাম্প এবং জেলেনস্কির বৈঠকের কথা। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, খনিজ বণ্টন চুক্তি— এই দুইই ছিল ট্রাম্প-জেলেনস্কির বৈঠকের মূল বিষয়।


চলতি মাসের গোড়ায় মার্কিন সামরিক সহায়তার বিনিময়ে ইউক্রেনের খনিজে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন জেলেনস্কি। পরে অবশ্য রাজি হয়ে যান চুক্তিপত্র চূড়ান্ত করতে। ট্রাম্প প্রশাসন তো বটেই, অনেকেই ভেবে নেন, হোয়াইট হাউসে বৈঠকেই ওই চুক্তিপত্রে সাক্ষর করবেন জেলেনস্কি। কিন্তু বাস্তবে তা হল না। ওভাল অফিসে দুই রাষ্ট্রনেতার ৪০ মিনিটের বৈঠক, পাল্টে দিল সব সমীকরণ। খনিজ বণ্টন চুক্তি তো এগোলই না, আগেই ভেস্তে গেল বৈঠক। নেপথ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গ।


ট্রাম্পের সমঝোতা-শর্ত


ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে নীতি পরিবর্তন করাতেই ‘বিপদ’ বৃদ্ধি পায় ইউক্রেনের। হোয়াইট হাউসের বৈঠকে প্রথম থেকেই জেলেনস্কির উপর ‘চাপ’ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন ট্রাম্প। প্রথমেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে জানান, রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছনোর জন্য ইউক্রেনকে ‘সমঝোতা’ করতে হবে। যুদ্ধের অবসান করতে যুক্তরাষ্ট্র সব রকম সাহায্য করবে বলেও আশ্বাস দেন ট্রাম্প। কিন্তু ‘সমঝোতা’তে নারাজ জ়েলেনস্কি। সাংবাদিকদের সামনে বৈঠকের মাঝে ‘অনড়’ জেলেনেস্কিকে ট্রাম্প বলেন, ‘শান্তি চুক্তির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনকে চুক্তি করতেই হবে। তার জন্য কিছু আপসও করতে হবে, তবে তা খুব বেশি নয়।’ তারপরেই যোগ করেন, ‘চুক্তিবদ্ধ না-হলে আপনার সঙ্গে থাকবে না যুক্তরাষ্ট্র। আপনাকে একাই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’


বৈঠক শেষে ট্রাম্পের বার্তা


শেষ পর্যন্ত বৈঠক থেকে কোনও রফাসূত্র বার হয়নি। বাতিল হয়ে যায় যৌথ সাংবাদিক বৈঠকও। হোয়াইট হাউস ছেড়ে বেরিয়ে যান জেলেনস্কি। গোটা ঘটনা শেষে সমাজমাধ্যমে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আজ হোয়াইট হাউসে আমাদের একটি অত্যন্ত অর্থবহ বৈঠক হয়েছে। এমন অনেক কিছু শিখেছি যা এমন অগ্নিগর্ভ ও চাপের পরিস্থিতির মধ্যে আলোচনা ছাড়া সম্ভব হত না। আবেগের মাধ্যমে যা বেরিয়ে এসেছে তা আশ্চর্যজনক।’ এরপরেই ট্রাম্পের মন্তব্য, ‘‘বুঝেছি, যুক্তরাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা থাকলে জেলেনস্কি শান্তি প্রক্রিয়ায় শামিল হবেন না। কারণ, তিনি মনে করেন, আমাদের ভূমিকা তাকে আলোচনায় একটি বড় সুবিধা দেবে। সুবিধা দিতে চাই না, শান্তি চাই।’ জেলেনস্কি ওভাল অফিসে বসে যুক্তরাষ্ট্রকে অসম্মান করেছেন বলে জানিয়ে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘শান্তির জন্য সম্মত হলে তিনি ফিরে আসতে পারেন।’


যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউক্রেনের মধ্যে বিশেষ খনিজ চুক্তি নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই কথাবার্তা চলছে। ইউক্রেনে কিছু বিরল খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়। সেই খনির দিকে যুক্তরাষ্ট্রের নজর। চুক্তি অনুযায়ী, বিনা বাধায় সেই খনি ব্যবহারের অনুমতি পাওয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্রের। ট্রাম্প সেই কারণেই এই চুক্তিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিরল খনিজ ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে তার বদলে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন জেলেনস্কি। 

 

বার বারই নিজের নানা আচরণে ট্রাম্প একটা কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন— কোনও স্বেচ্ছাসেবায় তিনি আগ্রহী নন। যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হবে, এমন চুক্তি বা সমঝোতাতেই তিনি আগ্রহী। জেলেনস্কি সে কথা ভেবেই খনিজ চুক্তির প্রস্তাব দেন। কিন্তু চুক্তির শর্তে দুই দেশ শেষ পর্যন্ত একমত হতে পারেনি। জেলেনস্কির অভিযোগ, ট্রাম্প কেবল খনিজেই আগ্রহী। ইউক্রেনের নিরাপত্তার বিষয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই তাঁর। বরং তিনি রাশিয়ার সঙ্গে হাত মেলাতেও প্রস্তুত! 


নিজের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ট্রাম্পও বিশেষ রাখঢাক করেননি। তিনি আগেই জানান, ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ইউরোপের। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সেনাবাহিনী ওই দেশে রয়েছে। তার জন্য যতটা নিরাপত্তা প্রদান সম্ভব, ট্রাম্প তার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তার বেশি কিছু যে তিনি করতে চান না, তা বুঝিয়ে দেন। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতি বা ইউক্রেনের নিরাপত্তার বিষয়ে আপস না-করা নিয়ে জেলেনস্কি অনড় থাকায় তাই ট্রাম্পের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। সেই কারণেই ভেস্তে গেল খনিজ চুক্তি।


যা বলা হয় খনিজ চুক্তির শর্তে


খনিজ চুক্তি অনুযায়ী, ইউক্রেনের পুনর্গঠনের স্বার্থে একটি বিনিয়োগ তহবিল গড়ে তোলা হবে। কিয়েভ এবং ওয়াশিংটন এই তহবিল সমান ভাবে পরিচালনা করবে। ইউক্রেনের রাষ্ট্রায়ত্ত খনি থেকে যা উত্তোলন করা হবে, তার ৫০ শতাংশ এই তহবিলে জমা দেবেন জেলেনস্কি। ইউক্রেনের নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের স্বার্থে সেই তহবিলে বিনিয়োগ করা হবে। ইউক্রেনের আর্থিক অগ্রগতি এবং স্থিতাবস্থার প্রতি যুক্তরাষ্ট্র দায়বদ্ধ থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রর এই অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হবে। ইউক্রেনের খনি ব্যবহার করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। যুগ্ম তহবিলের অধিকাংশ যুক্তরাষ্ট্রর মালিকানাধীন থাকবে।


যুক্তরাষ্ট্র ৫০ হাজার কোটি ডলার মূল্যের খনিজ চেয়ে পাঠায় ইউক্রেনের কাছে। জেলেনস্কি সেই আবেদন খারিজ করে দেন। মঙ্গলবার ট্রাম্প জানান, যুক্তরাষ্ট্র ৩০ হাজার কোটি ডলার অর্থসাহায্য করেছে ইউক্রেনকে। খনিজ চুক্তির মাধ্যমে সেই অর্থ তিনি ফেরত নিতে চান। বস্তুত, ইউক্রেনের সঙ্গে এই খনিজ চুক্তিকে ট্রাম্প অন্য ভাবে দেখছেন। তিনি প্রকাশ্যেই দাবি করেছেন, বছরের পর বছর ধরে মার্কিন করদাতাদের অর্থ ইউক্রেনে গিয়েছে। এবার ইউক্রেনের দায়িত্ব ইউরোপের অন্য দেশগুলিকে নিতে হবে। ইউক্রেনের খনিজের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সেই অর্থ ফেরত নেবে। ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে খনিজ চুক্তি স্বাক্ষর করবেন না, সাফ জানিয়ে দেন জেলেনস্কি। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধও বন্ধ হবে না।


কী কী খনিজ আছে ইউক্রেনে


কিয়েভের দাবি, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থগুলির পাঁচ শতাংশ ইউক্রেনে আছে। ১.৯০ কোটি টন গ্রাফাইটের মালিক ইউক্রেন, যা সারা বিশ্বের মোট সঞ্চয়ের ছয় শতাংশ। এই ধাতু বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যাটারি তৈরিতে অপরিহার্য। এ ছাড়াও ইউক্রেনে আছে প্রচুর পরিমাণ টাইটানিয়াম (বিশ্ব সঞ্চয়ের এক শতাংশ) এবং লিথিয়াম (বিশ্ব সঞ্চয়ের এক থেকে দুই শতাংশ)। রয়েছে ইউরেনিয়াম (বিশ্ব সঞ্চয়ের দুই থেকে চার শতাংশ)। অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামালের (রেয়ার আর্থ মিনারেল) খনি ইউক্রেস। তবে যুদ্ধের কারণে এই খনিগুলিতে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইউক্রেনের দাবি, রাশিয়া এই খনিগুলির অনেকটা অংশ গায়ের জোরে দখল করে নিয়েছে।


ট্রাম্পের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ


ট্রাম্পের সঙ্গে বাগ্‌যুদ্ধের দিনই জেলেনস্কি জানান, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ। তবে যুদ্ধবিরতি নিয়ে নিজের অবস্থানে অনড় থাকারই ইঙ্গিত দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। জানিয়েছেন, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়া ইউক্রেনের জন্য বিপজ্জনক। শনিবার সমাজমাধ্যমে এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘আমরা খনিজ চুক্তি করতে প্রস্তুত। এবং সেটাই হবে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা করার প্রথম ধাপ। কিন্তু সেটাই শুধু যথেষ্ট নয়। আমরা আরও একটু বেশি কিছু চাই। আপাত ভাবে অনেকেই বিষয়টি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সুর নরমের চেষ্টা বলে মনে করছেন।


দুই রাষ্ট্রনেতার বাগ্‌যুদ্ধের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কোন দিকে এগোবে? জ়েলেনস্কি কি ‘বিপদ’ ডেকে আনলেন ইউক্রেনের জন্যে? এমন নানা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকের মতে, ট্রাম্প অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেনের বিপক্ষে চলে যায় তাতে চাপে পড়তে পারেন জেলেনস্কি! রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চালাতে গেলে ইউক্রেনের প্রয়োজন সামরিক সাহায্য। যা তারা এত দিন পেয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। সেই সাহায্য বন্ধ হলে সমস্যায় পড়বে ইউক্রেন। রুশ সেনার সঙ্গে লড়াই জারি রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। আর সেই কথা ভেবেই কি যুদ্ধবিরতির শর্তে অনড় থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন চাইলেন জেলেনস্কি? এখন দেখার ট্রাম্প বা মার্কিন প্রশাসনের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয়? যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া দিতে উদ্যোগী হন কি না জেলেনস্কি?


সূত্র: স্কাই নিউজ, রয়টার্স ও বিবিসি


এসজেড