ক্যাম্বোডিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় আনলং ভেং-এ পল পটের দাহস্থলে কফিন আকৃতির একটি নতুন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। স্বচ্ছ প্লাস্টিক ছাদে ঢাকা এই কাঠামোটি যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে পল পটের শাসনামলে গণহত্যার শিকার আনুমানিক ২০ লাখ মানুষের স্মৃতি।
আনলং ভেং থেকে এএফপি জানায়, পঞ্চাশ বছর আগে, ঠিক এই দিনেই (১৪ এপ্রিল), পল পটের নেতৃত্বাধীন খেমার রুজ বাহিনী রাজধানী নম পেন দখল করে। ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যাকারী হিসেবে তার উত্তরাধিকার আজও আধুনিক ক্যাম্বোডিয়ার ওপর এক দীর্ঘ ছায়া ফেলছে। ড্যাংরেক পর্বতমালার আনলং ভেং এখন দেশটির স্মৃতি ও পুনর্মিলনের জটিল বাস্তবতা উপলব্ধির এক ভিন্নধর্মী স্থান হয়ে উঠেছে।
খেমার রুজ গোষ্ঠী রাষ্ট্রের বর্ষপঞ্জি পুনরায় ‘শূন্যতম বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে শুরু করে এক নৃশংস শাসন। তারা টাকা, শ্রেণি ও ধর্মহীন’ এক আদর্শ কৃষক সমাজ গঠনের নামে রাজধানী খালি করে গ্রামীণ এলাকায় মানুষ পাঠায়। পরবর্তী চার বছরে দেশটির এক-চতুর্থাংশ মানুষ মারা যায়—ক্লান্তি, অনাহার, রোগ, নির্যাতন বা হত্যার শিকার হয়ে।
ভিয়েতনামের মদদপুষ্ট বাহিনীর হাতে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে খমের রুজ সীমান্তবর্তী কয়েকটি ঘাঁটিতে সরে যায়। দলীয় কোন্দলের মধ্যে নেতৃত্ব হারান পল পট। ১৯৯৮ সালে তিনি মারা যান এবং পুরনো টায়ারের স্তূপের ওপর তার দেহ দাহ করা হয়। ‘মানুষের মর্যাদা যতই উঁচু হোক না কেন, মৃত্যুর পর সবার জায়গা একটাই—কফিন,’ বলেন নতুন কাঠামোর সহ-নকশাবিদ ছোয়েন ভানেত। ধাতব কাঠামোর মরিচা প্রতীকীভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে খমের রুজের ‘গণহত্যার শাসন’-কে।
এই ছাঁদ নির্মাণের উদ্দেশ্য ইতিহাসের সাক্ষ্য সংরক্ষণ, জানান ডকুমেন্টেশন সেন্টার অব ক্যাম্বোডিয়ার (ডিসিক্যাম) পরিচালক ইউক চ্যাং। তার নেতৃত্বে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্বোডিয়া সেইসব দেশগুলোর একটি, যারা এমন এক হত্যাকারীর সমাধিস্থল সংরক্ষণ করে। সংরক্ষণ না করা হলে এটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে—তখন তরুণ প্রজন্মের কাছে পল পট যে ছিলেন, সে বিশ্বাসই থাকবে না।’
ক্যাসিনোর ছায়া
আনলং ভেং এলাকায় এখনও হাজার হাজার প্রাক্তন খেমার রুজ সদস্য ও তাদের উত্তরসূরি বাস করেন। এখানেই আছে ব্যাংকের শাখা, বৌদ্ধ মন্দির, এমনকি পল পটের দাহস্থলের ১০০ মিটার দূরেই একটি বহুতল ক্যাসিনো। তবে এলাকায় অনেকে এখনও পল পটের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
৬৫ বছর বয়সী সাবেক খেমার রুজ সেনা পেন পেউন বলেন, ‘তিনি এতটা খারাপ ছিলেন না। মনে করি না তিনি কাউকে হত্যা করেছেন। তবে সবারই মতামত থাকতে পারে।’ ১৯৮৪ সালে ল্যান্ডমাইনে পা হারানো ৭২ বছর বয়সী ফং হিয়াং বলেন, ‘আমার কোনো অনুশোচনা নেই। খেমার রুজ সদস্য হিসেবে লজ্জিত নই। কেবল আদেশ পালন করেছি। আমি চাই অতীতকে কবর দিতে।’
গবেষকদের মতে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী হন সেনের পুনর্মিলন নীতির ফলে অধিকাংশ খেমার রুজ সদস্যকে সমাজে ফিরিয়ে আনা হয়, যার ফলে ইতিহাসের সৎ বিবেচনায় রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছে। ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনামের সমর্থনে গঠিত কর্তৃপক্ষ পল পটকে অনুপস্থিত অবস্থায় গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক কোনো আদালতে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।
জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ২০২২ সালে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ খেমার রুজ নেতাকে দোষী সাব্যস্ত করে কার্যক্রম শেষ করে। তবে অন্য বহু সাবেক নেতা এখনও স্বাধীনভাবে বসবাস করছেন।
সাবেক সামরিক কমান্ডার টা মোকের বাড়িতে একদল উচ্চবিদ্যালয় শিক্ষার্থীর সামনে খেমার রুজ শাসনের অপরাধ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন গবেষক সৌত ভিচেত—যিনি নিজেও খেমার রুজ সদস্যের সন্তান ও নাতি। তিনি বলেন, ‘পুনর্মিলন ও ঐতিহাসিক শিক্ষার কাজ শেষ হবার নয়।’
সূত্র: এএফপি
এসজেড