ঢাকা | বঙ্গাব্দ

আফগানিস্তানে মৃত্যু ঝুঁকিতে লাখো শিশু

যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হওয়ার পর এএসএফ তাদের ৯০০ কর্মীর মধ্যে ১৫০ জনকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়।
  • অনলাইন ডেস্ক | ১৬ এপ্রিল, ২০২৫
আফগানিস্তানে মৃত্যু ঝুঁকিতে লাখো শিশু বন্ধ হয়ে যাওয়া চিকিৎসাকেন্দ্র।

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের একটি অপুষ্টি চিকিৎসাকেন্দ্রে এখন শিশুদের কান্নার পরিবর্তে নেমে এসেছে ভারী নিস্তব্ধতা। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ছাঁটাই করা হয়েছে। কাবুল থেকে এএফপি জানায়, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে বিদেশি সহায়তা বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়ায় সম্পূর্ণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত এই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেছে।


এই কেন্দ্রটি পরিচালনাকারী বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এগেইনস্ট হাঙ্গার (এএসএফ)-এর দেশীয় পরিচালক কোবি রিটভেল্ড বলেন, ‘এই কেন্দ্র যেসব শিশুদের সেবা দিত, তারা আর এখন চিকিৎসা পাবে না। আর চিকিৎসা না পেলে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি খুবই বেশি।’ নতুন কোনো অর্থায়ন না থাকায় মার্চে শেষ রোগী চলে যাওয়ার পর থেকে খেলনা, শিশুখাদ্য, বোতল সব সরিয়ে রাখা হয়েছে, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ফার্মেসিও।


চিকিৎসাকেন্দ্রের প্রধান চিকিৎসক ফারিদ আহমাদ বারাকজাই বলেন, ‘যখন অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা আমাদের কাছে আসে, তখন আমাদের কর্মীদের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজটি হচ্ছে তাদের বুঝিয়ে বলা—এখন এখানে সেবা দেওয়া সম্ভব নয়, অন্য কোথাও যেতে হবে।’ জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, চার দশকের যুদ্ধ ও সংকট পেরিয়ে আফগানিস্তান বর্তমানে যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মানবিক সংকটে রয়েছে। 


গড় হিসেবে, এই চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রতি মাসে জটিল ও তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা ৬৫টি শিশুর চিকিৎসা হতো। তারা কয়েকদিন থাকত মায়েদের সঙ্গে—শুধু পুষ্টি পাওয়ার জন্য নয়, বরং রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রোধ করতেও। ‘যে কোনো সংক্রমণ যেটি একটি শিশু পেতে পারে, অপুষ্ট শিশু সেটি আরও বেশি ঝুঁকিতে পায়,’ বলেন রিটভেল্ড। তিনি আরও বলেন, ‘এটি আমাদের কর্মীদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক, কারণ তারা জানে অন্য কোথাও এই ধরনের বিশেষায়িত সেবা নেই, তবুও তাদের সেদিকেই পাঠাতে হয়।’


আফগানিস্তানে যেখানে জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশই ১৪ বছরের নিচে, সেখানে শিশুর অপুষ্টি একটি গুরুতর সংকট। কারণ এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাবিত করে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৩৫ লাখ শিশু বর্তমানে তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে এবং দেশটিতে বিশ্বের অন্যতম উচ্চ হারে বামনত্ব দেখা যায়।


প্রাপ্তবয়স্করাও বাদ যাচ্ছে না, বর্তমানে ১ কোটি ৫০ লাখ আফগান খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, যার মধ্যে ৩.১ মিলিয়ন ইতোমধ্যে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। গত সপ্তাহে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানায়, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সংস্থাটির কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে—যদিও অন্য কিছু দেশে বরাদ্দ আবার চালু করেছে।


‘এই দেশটি বহুবার আঘাত পেয়েছে,’ বলেন আফগানিস্তানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি এডউইন সেনিজা সালভাদোর। তিনি বলেন, ‘এই ভঙ্গুর ব্যবস্থায় এমনকি প্রাথমিক স্ক্রিনিং ব্যবস্থাও নেই। আর তাই, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।’


এই তহবিল সংকটের ফলে মানবিক সহায়তাক্ষেত্রে ব্যাপক ছাঁটাই হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে আফগানিস্তানে বেকারত্বের হার ১২.২ শতাংশে পৌঁছে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হওয়ার পর এএসএফ তাদের ৯০০ কর্মীর মধ্যে ১৫০ জনকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়। রিটভেল্ড বলেন, ‘আমার অফিসে মানুষ কাঁদছে। আমরা শুধু শুনতে পারি, সমবেদনা জানাতে পারি—কিন্তু চাকরি দিতে পারি না।’


সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নারী কর্মীরা। অপুষ্টি কেন্দ্রে ৪০ জন কর্মীর বেশিরভাগই ছিলেন নারী, যাদের ওপর ২০২১ সালে তালেবানের ক্ষমতায় ফেরার পর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তাদের এখন অনেক ক্ষেত্রে কাজ করতে দেওয়া হয় না, প্রাথমিক শিক্ষার পর পড়াশোনাও নিষিদ্ধ—শুধুমাত্র ধর্মীয় স্কুলে ভর্তির সুযোগ রয়েছে। জাতিসংঘ একে বলেছে ‘লিঙ্গ-ভিত্তিক বর্ণবাদ’। ২৭ বছর বয়সী নার্স ওয়াজমা নূরজাই বলেন, ‘আমাদের অনেকের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রই ছিল একমাত্র কাজের জায়গা। এখন সেটাও হারাতে বসেছি।’


যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা, যা স্থানীয় বাজেটের ৩০ শতাংশ জোগান দিত, হারানোর পর সংস্থাটি এখন ‘প্রস্তাবনা প্রস্তুত করছে’ এবং ‘দাতাদের সঙ্গে আলোচনা করছে’—বলেছেন রিটভেল্ড। তবে তিনি বিশ্বাস করেন না যে অন্য দাতারা এই ঘাটতি পূরণ করতে পারবে।


সূত্র: এএফপি


এসজেড