বিলিয়নিয়ার ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর বৈশ্বিক কর ব্যবস্থা কার্যকর করার পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে, কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র এসব সংস্কার পরিকল্পনাকে বাধা দিচ্ছে। প্যারিস থেকে এএফপি জানায়, এই রিয়েল এস্টেট ধনকুবের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর কর আরোপ সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন এবং যেসব দেশ মার্কিন টেক জায়ান্টদের লক্ষ্যবস্তু করছে, তাদের ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন।
আমাজন, মাইক্রোসফট, গুগলের মালিক অ্যালফাবেট এবং ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার বিরুদ্ধে স্থানীয় কর এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলেছে বিভিন্ন দেশ। চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, যেসব দেশ ‘বৈষম্যমূলক, অতিরিক্ত’ অথবা স্থানীয় কোম্পানিগুলোর লাভ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মার্কিন কোম্পানিগুলোর ওপর জরিমানা বা কর আরোপ করবে, তাদের বিরুদ্ধে তার প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।
তিনি বলেন, ‘আমার প্রশাসন পদক্ষেপ নেবে—যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সুরক্ষায় প্রযোজ্য হলে শুল্ক আরোপসহ অন্যান্য প্রতিক্রিয়ামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ এই অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মধ্যে ডিজিটাল সেবার ওপর কর নিয়ে পুরনো মতবিরোধকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে।
প্রথম দফা প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ট্রাম্প ২০১৯ সালে ফ্রান্স ডিজিটাল সেবার ওপর কর আরোপ করলে ফরাসি শ্যাম্পেন ও পনিরের ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দেন। এরপর আরও সাতটি দেশ ফ্রান্সের পথ অনুসরণ করেছে। গত বছর ফরাসি সরকার এই কর থেকে ৭৮ কোটি ইউরো (৮৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার) আয় করেছে। এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন হুমকি দিচ্ছে, তারা ডিজিটাল সেবার ওপর কর আরোপ করবে, যদি ট্রাম্প ইইউ পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পরিকল্পনায় অটল থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করার আশায় থাকা ব্রিটেনও হয়তো তার নিজস্ব ডিজিটাল কর পুনর্বিবেচনা করতে পারে। এই কর বর্তমানে বার্ষিক প্রায় ৮০০ মিলিয়ন পাউন্ড আয় করে। ব্রিটিশ বাণিজ্য সচিব জোনাথন রেনল্ডস বলেন, ‘এই কর কোনো পবিত্র বিষয় নয়, যেটি কখনো পরিবর্তন করা যাবে না বা যার বিষয়ে আলোচনা সম্ভব নয়।’
২০২১ সালে প্রায় ১৪০টি দেশ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর কর আরোপে একটি চুক্তিতে পৌঁছায়, যা অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি)-র নেতৃত্বে আলোচনার মাধ্যমে অর্জিত হয়। এই চুক্তির দুটি প্রধান স্তম্ভ রয়েছে। প্রথমটি হলো, কোম্পানিগুলো যেসব দেশে লাভ করে, সেসব দেশেই তাদের কর পরিশোধ করতে হবে। এর লক্ষ্য কর ফাঁকি রোধ। এটি মূলত টেক জায়ান্টদের লক্ষ করে। দ্বিতীয় স্তম্ভ অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ১৫ শতাংশ কর হার নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি ব্রাজিল, ব্রিটেন, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সুইজারল্যান্ড এবং জাপানসহ প্রায় ৬০টি অর্থনীতি গ্রহণ করেছে।
মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ট্যাক্স ফাউন্ডেশনের প্রধান ড্যানিয়েল বান বলেন, প্রথম স্তম্ভ কার্যকরে আলোচনা অনেকদিন ধরেই স্থগিত রয়েছে—জো বাইডেনের সময়েও তা অগ্রসর হয়নি। ফরাসি-মার্কিন অর্থনীতিবিদ গ্যাব্রিয়েল জাকমান বলেন, ‘পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। যদি ইইউ এবং অন্যান্য দেশ পিছু হটে এবং মার্কিন বহুজাতিকদের ছাড় দেয়, তবে দুর্ভাগ্যবশত এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির অবসান ঘটবে।’
বিশ্বের অতি ধনীদের ওপর কর আরোপের প্রচেষ্টাও স্থবির হয়ে পড়েছে। জি২০-তে সভাপতিত্বকালে ব্রাজিল এমন একটি প্রস্তাব তোলে যাতে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের নেট সম্পদের ওপর দুই শতাংশ হারে ন্যূনতম কর আরোপের কথা বলা হয়। এটি প্রতি বছর প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আনতে পারে বলে ধারণা।
বাইডেন প্রশাসন এই প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে, আর ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে থাকলে এটি কার্যকর হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই—তিনি নিজেও একজন বিলিয়নিয়ার এবং কর হ্রাসের পক্ষে। ফোর্বস ম্যাগাজিনের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ বিলিয়নিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের, যা চীন, ভারত ও জার্মানির সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশি। সম্প্রতি প্যারিসে এক সম্মেলনে ফরাসি অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেতি বলেন, ‘আমরা জি২০ুর সম্মিলিত সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। ইতিহাস বলে, একবার কোনো একটি বা দুটি শক্তিশালী দেশ কোনো সংস্কার গ্রহণ করলে, তা ধীরে ধীরে নতুন মানদণ্ডে পরিণত হয়।’
সূত্র: এএফপি
এসজেড