করোনাকালে সরবরাহব্যবস্থার বিপর্যয়ের কারণে বাণিজ্যিক বিমানের দাম গত কয়েক বছরে অনেকটাই বেড়েছে। তবে বোয়িং ও এয়ারবাস এখন নতুন করে ট্রেড ট্যারিফের চাপের মুখে পড়ায় এই দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। নিউইয়র্ক থেকে এএফপি জানায়, একজন বেসরকারি উড়োজাহাজ বিশেষজ্ঞ এএফপিকে বলেন, ‘২০১৮ সালের তুলনায় এখন বাণিজ্যিক বিমানের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে।’
গোপনীয়তার শর্তে কথা বলা ওই বিশেষজ্ঞ জানান, কাঁচামাল, টাইটেনিয়াম, যন্ত্রাংশ, জ্বালানি ও শ্রমিক মজুরির বাড়তি খরচ এই বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। গত বছর একটি শ্রমিক ধর্মঘটের অবসান ঘটাতে বোয়িং তাদের সিয়াটলভিত্তিক যন্ত্রপাতি কর্মী ইউনিয়নের সঙ্গে চার বছরে ৩৮ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির চুক্তি করে। একই সময়ে বোয়িং ও এয়ারবাসের প্রধান সরবরাহকারী স্পিরিট অ্যারো সিস্টেমসও একই ধরনের মজুরি বাড়ানোর চুক্তিতে পৌঁছে।
অ্যারোডাইনামিক অ্যাডভাইজরির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিচার্ড আবুলাফিয়া বলেন, ‘কাস্টিং, ফরজিং এবং টাইটেনিয়ামের মতো উপাদানের দাম মারাত্মকভাবে বেড়েছে—বিশেষ করে রাশিয়ার সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছুটা হলেও ইউরোপের জন্য।’
আবুলাফিয়ার হিসাবে, ২০২১ সালের পর থেকে বিমান তৈরির কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে ট্রাম্প আমলের ২৫ শতাংশ স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম ট্যারিফ, যা বিমানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তিনি বলেন, ‘আসলে বিষয়টা বেশ বৈপরীত্যপূর্ণ। শুরুতে কাঁচামাল কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প এটাকে সমস্যা বানিয়ে তুলছেন।’
এয়ারক্রাফট ভ্যাল্যু নিউজের-প্রধান সম্পাদক জন পারসিনোস বলেন, ‘বিমান শিল্পে মূল্যস্ফীতি বাড়ছেই। এখন এই নতুন ট্যারিফগুলো পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করবে। এটি একটি ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ।’ তবে নতুন প্রজন্মের বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স, ৭৮৭ ড্রিমলাইনার এবং এয়ারবাসের এ৩২১নিওুএর মতো মডেলগুলো কম জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করায় এগুলোর দাম তুলনামূলক বেশি রাখা যায়।
তবে এই মূল্যবৃদ্ধি এখনও কোম্পানিগুলোর আনুষ্ঠানিক তালিকাভুক্ত দামে প্রতিফলিত হয়নি। বোয়িং ২০২৩ সালের পর আর মূল্য তালিকা হালনাগাদ করেনি। এয়ারবাসের শেষ হালনাগাদ হয় ২০১৮ সালে। আবুলাফিয়া বলেন, ‘মূল্য তালিকা তো কল্পনারই কিছু ছিল। আপনি যদি ভালো পোশাক পরে যান, তাহলে হয়তো ৫০ শতাংশ ছাড় পাবেন।’
এয়ারবাস নিজেই স্বীকার করেছে যে, তারা অনেক আগেই তালিকাভুক্ত মূল্য ব্যবস্থাকে পরিত্যাগ করেছে, কারণ প্রতিটি বিমানের চূড়ান্ত দাম নির্ধারিত হয় বিমানের কনফিগারেশন ও অন্যান্য চুক্তিভিত্তিক সেবার ওপর। বিশেষজ্ঞরা জানান, বিমানের সহায়ক সেবা, প্রশিক্ষণ, বা সরবরাহকাল বিলম্বজনিত কারণে দাম সমন্বয়ের মতো বিষয়গুলো থাকে, ফলে তালিকাভুক্ত দাম বাস্তবতার প্রতিফলন করে না।
বোয়িং এএফপিকে জানিয়েছে, তারা উৎপাদন ব্যয় ও বাজার পরিস্থিতির ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ করে, তবে প্রতিযোগিতার স্বার্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানায় না। বর্তমানে বোয়িং ও এয়ারবাস উভয়েরই বড় অর্ডার ব্যাকলগ রয়েছে, যা অন্তত দশকজুড়ে তাদের ব্যস্ত রাখবে। তবে এই চাহিদা খুব বেশি দামের ঊর্ধ্বগতিতে প্রভাব ফেলছে না।
একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এটি খুব প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার। প্রতিটি চুক্তির জন্য দুই কোম্পানি কঠিন প্রতিযোগিতায় নামে, যা দাম কম রাখায় বাধ্য করে।’ করোনার পর বাড়তি চাহিদা, বেশি দামেও চলছে বিক্রি রোনাল্ড বার্জার পরামর্শ সংস্থার মানফ্রেড হ্যাডার বলেন, ‘করোনার আগেও বোয়িং ও এয়ারবাস যে বাজারে প্রতিযোগিতা করছিল, সেখানে দামে একরকম মন্দা ছিল, অনেক সময় তা খুবই কম ছিল।’
তবে করোনা-পরবর্তী পর্যটনবাজার চাঙ্গা হওয়ায় বিমানের টিকিটের দাম ও বিমান সংস্থাগুলোর লাভ বেড়েছে, ফলে তারা তুলনামূলক বেশি দামে বিমান কিনতে পারছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাপানের এএনএ একসঙ্গে বোয়িং, এয়ারবাস এবং ব্রাজিলিয়ান এমব্রায়ের কোম্পানি থেকে মোট ৭৭টি বিমান অর্ডার করেছে। তখন তারা যে হালনাগাদ তালিকামূলক দাম দিয়েছে, তা আগের তুলনায় অনেকটাই বেশি।
এএফপি’র হিসাব অনুযায়ী, বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের মূল্য ধরা হয়েছে প্রায় ৩৮৬ মিলিয়ন ডলার (৩ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা), যা ২০২৩ সালে ছিল ২৯২ মিলিয়ন ডলার। ৭৩৭ ম্যাক্সের দাম বেড়ে ১৫৯ মিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা আগে ছিল ১২১.৬ মিলিয়ন ডলার। এয়ারবাসের এ৩২১নিওর দাম ২০১৮ সালের তুলনায় বেড়ে এখন প্রায় ১৪৮ মিলিয়ন (১৪.৮ কোটি) ডলার হয়েছে।
সূত্র: এএফপি
এসজেড