কেনিয়ার ক্রীড়া তারকা অ্যাগনেস টিরপকে ছুরিকাঘাতে হত্যার দুই বছর পর মূল সন্দেহভাজন জামিনে মুক্তি পেয়ে উধাও হয়ে গেছেন—এটি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার নারীদের প্রতি কেনিয়ার ব্যর্থতার জ্বলন্ত প্রমাণ বলে মনে করেন অধিকারকর্মীরা।
নাইরোবি থেকে এএফপি জানায়, এনজিও পরিচালিত ‘সাইলেন্সিং উইমেন প্রজেক্ট’-এর তথ্যমতে, কেনিয়ার ৪৭টি কাউন্টির মধ্যে মাত্র ১০টিতেই গত বছর ১৭০টি নারী হত্যার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যা দেশটির নারীদের জন্য ‘এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ‘নারীহত্যা’ বলতে সাধারণত এমন হত্যাকাণ্ড বোঝানো হয় যেখানে স্বামী, সঙ্গী বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের দ্বারা নারীর হত্যা ঘটে এবং এতে ভুক্তভোগীর নারী পরিচয়টি মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
২০২১ সালের অক্টোবরে ১০ হাজার মিটার দৌড়ে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ব্রোঞ্জজয়ী টিরপকে হত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে আলোচিত নারীহত্যাগুলোর অন্যতম। এটি বিচারব্যবস্থার ত্রুটিগুলোকেও সামনে এনেছে।
তিরপের স্বামী ইব্রাহিম রোতিচ (৪৫) এই মামলার প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে বিবেচিত হলেও ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে তাকে চার লাখ কেনিয়ান শিলিং (তৎকালীন প্রায় ২,৭০০ মার্কিন ডলার) জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। ভুক্তভোগীর বাবা ভিনসেন্ট টিরপ জানান, জামিনের এই সিদ্ধান্ত তাদের পরিবারের জন্য ছিল বজ্রাঘাতের সমান। ‘আমরা যে বিচার চাইতে আইনের শরণাপন্ন হয়েছিলাম, সেই ব্যবস্থার দ্বারাই প্রতারিত হলাম,’ এএফপিকে বলেন তিনি।
পরিবারের আইনজীবী রিচার্ড ওয়ারিগি জানান, জামিন ঠেকাতে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন, কারণ রোতিচ পালিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল স্পষ্ট। হত্যাকাণ্ডের পরদিনই রোতিচকে অপরাধস্থল থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে মোম্বাসা বন্দরের শহরে এক নাটকীয় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে তদন্ত কর্মকর্তা জানান, দুই বছর আটক থাকার পর জামিন পাওয়া তার অধিকার। এরপর মামলায় তিনটি শুনানি হয়েছে, কিন্তু রোতিচ, যাকে প্রতি সপ্তাহে থানায় হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল, সে নিখোঁজ। ভিনসেন্ট টিরপ বলেন, ‘এখন সে পলাতক, কেউ জানে না সে কোথায় আছে।’
একজন তারকা ক্রীড়াবিদের ক্ষেত্রেও যদি এমনটা হয়, তাহলে যেসব ঘটনা আলোচনায় আসে না, সেগুলোর অবস্থা সহজেই অনুমেয়—বলেছেন নারী অধিকারকর্মী রাচেল এমউয়াকালি। ‘এটি পুলিশের ব্যর্থতা, বিচারব্যবস্থার ব্যর্থতা এবং রাষ্ট্রের ব্যর্থতা,’ বলেন তিনি। সাইলেন্সিং উইমেন প্রজেক্ট-এর কর্মী জাহা ইন্ডিমুলি বলেন, নারী হত্যা সংক্রান্ত মামলাগুলোর তদন্তে পুলিশের পক্ষ থেকে ‘সম্পূর্ণ অবহেলা’ দেখা যায়।
তার ভাষ্য, অভিযোগের তারিখ ও সময় ভুলভাবে লিপিবদ্ধ হয়, ভুক্তভোগীদের কথায় গুরুত্ব দেওয়া হয় না, এমনকি অনেকেই আশ্রয়স্থল না থাকায় নির্যাতকের কাছেই ফিরে যেতে বাধ্য হন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কেনিয়ান পুলিশের লিঙ্গ বিষয়ক ইউনিটের প্রধান ইন্সপেক্টর জেনারেল জুডি লামেট। তিনি জানান, পুলিশ সদস্যরা এখন লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সংক্রান্ত ব্যাপক প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন এবং পারিবারিক নির্যাতনের শিকারদের জন্য টোল-ফ্রি হেল্পলাইন চালু আছে।
২০২২ সাল থেকে কেনিয়া লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সংক্রান্ত মামলার জন্য তিনটি বিশেষ আদালত স্থাপন করেছে। তবুও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের জাইনা কোম্বো বলেন, ফরেনসিক ল্যাব ও প্রসিকিউটরের দপ্তর অতিরিক্ত মামলার ভারে জর্জরিত।
সাইলেন্সিং উইমেন প্রজেক্ট জানায়, এসব মামলার রায় পেতে গড়ে চার বছর সময় লাগে। ‘লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার মামলাগুলোতে একেবারে কচ্ছপগতির বিচার হয়,’ বলেন কোম্বো। তিনি এর জন্য ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব’কে দায়ী করেন। প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো নারী সহিংসতা প্রতিরোধে একটি টাস্কফোর্স গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও, কোম্বো এতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ‘কেনিয়া এখনো একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ,’ বলেন তিনি।
ডিসেম্বরে নাইরোবিতে নারী হত্যার বিরুদ্ধে এক শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং কিছু অংশগ্রহণকারীকে আটক করে। এদিকে নারী হত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। এপ্রিলের শুরুতে নাইরোবির কাছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীকে দা দিয়ে আঘাত করা হয় এবং আরেক ছাত্রীর মরদেহ পানির ট্যাংক থেকে উদ্ধার হওয়ার পর একটি মোমবাতি প্রজ্বলন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
আয়োজক ডায়ানা নেকেসা বলেন, সেখানে কিছু পুরুষ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি আশার সঞ্চার করেছে। ‘সবাই সমর্থন করেছে, এমন নয়, তবে ভালো সংখ্যক ছেলেরা এসেছে,’ বলেন তিনি। তবে অন্য অনেকে, যারা ‘পুরুষ আধিপত্যে বিশ্বাসী এবং সামন্তবাদী মানসিকতায়’ আক্রান্ত, তারা এই অনুষ্ঠানকে উপহাস করেছে, যোগ করেন নেকেসা।
সূত্র: এএফপি
এসজেড