এপ্রিল মাসে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দেন, একটি দূরবর্তী গ্রহে ভিনগ্রহের জীবনের সম্ভাব্য ইঙ্গিত পাওয়া গেছে—এমন খবরে মানবজাতির মধ্যে আশার আলো জ্বলে ওঠে, যেন আমরা সত্যিই একা নই এই মহাবিশ্বে। প্যারিস থেকে এএফপি জানায়, তবে সাম্প্রতিক কয়েকটি গবেষণা একই তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছে, এমন উচ্চাশা পূর্ণ দাবিকে সমর্থন করার মতো প্রমাণ এখনও যথেষ্ট নয়। এক বিজ্ঞানী অভিযোগ করেছেন, গবেষকরা ‘অতিমাত্রায় তাড়াহুড়া’ করে ফেলেছেন।
এই বিতর্ক ঘিরে রয়েছে গ্রহ কে২-১৮বি, যা পৃথিবী থেকে ১২৪ আলোকবর্ষ দূরে, সিংহ (লিও) নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত। ধারণা করা হয়, গ্রহটি তার নক্ষত্র থেকে এমন দূরত্বে রয়েছে যেখানে তরল পানি থাকা সম্ভব, যা একে প্রাণের অনুসন্ধানে সম্ভাব্য প্রার্থী করে তোলে।গত মাসে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ব্যবহার করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দিয়েছিলেন, গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে ডাইমিথাইল সালফাইড (ডিএমএস) ও ডাইমিথাইল ডিসালফাইড (ডিএমডিএস) এর সম্ভাব্য উপস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
এই দুটি রাসায়নিক উপাদান পৃথিবীতে শুধুমাত্র সামুদ্রিক শৈবাল জাতীয় প্রাণের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়, ফলে এদেরকে সম্ভাব্য ‘বায়োসিগনেচার’, অর্থাৎ প্রাণের উপস্থিতির সংকেত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্বাধীন গবেষকরা অবশ্য তখনই সতর্কতা প্রকাশ করে বলেন, এটি কোনো চূড়ান্ত আবিষ্কারের দাবি নয়—শুধু সম্ভাব্য ইঙ্গিত। এই সিগন্যালের পরিসংখ্যানিক তাৎপর্য ‘তিন-সিগমা’ স্তরে পৌঁছেছে, যার অর্থ ১,০০০টির মধ্যে এখনও ৩টি ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
‘বায়োসিগনেচার উধাও’
লুইস ওয়েলব্যাংকস (অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি) এবং ম্যাথিউ নিকসন (মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি)—পরবর্তী সময়ে তথ্য পুনঃবিশ্লেষণ করে জানান, ভিন্ন পরিসংখ্যানিক মডেল ব্যবহার করলে বায়োসিগনেচারের দাবি আর টেকে না। তাদের প্রি-প্রিন্ট গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, পূর্ববর্তী গবেষণায় যেখানে ২০টি রাসায়নিক উপাদান ধরা হয়, তারা সেটি বাড়িয়ে ৯০টি করেছেন—যার মধ্যে ৫০টির বেশি ‘হিট’ পেয়েছে।
ওয়েলব্যাংকস বলেন, ‘যখন সবকিছুর ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তখন আসলে কিছুই নিশ্চিতভাবে ধরা পড়ে না।’ তবে তিনি এ-ও বলেন, গ্রহটিতে ডিএমএস রয়েছে কি না তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না—আরো পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।
‘বিতর্কই বিজ্ঞানকে এগিয়ে নেয়’
বিশ্ববিদ্যালয় টিম গত সপ্তাহে একটি নতুন প্রি-প্রিন্ট প্রকাশ করেছে, যেখানে রাসায়নিক উপাদানের সংখ্যা বাড়িয়ে ৬৫০ পর্যন্ত করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণে তিনটি সম্ভাব্য উপাদান চিহ্নিত হয়েছে—এর মধ্যে ডিএমএস ছিল, তবে ডিএমডিএস ছিল না, যদিও এপ্রিল মাসের ঘোষণায় এটি বড় ভূমিকা রাখে। বাকি দুটি উপাদান হলো ডাইইথাইল সালফাইড ও মিথাইল অ্যাক্রিলোনাইট্রাইল, যার মধ্যে শেষোক্তটি বিষাক্ত। মাধুসূদন স্বীকার করেছেন, এই উপাদানগুলো সম্ভবত কে২-১৮বিুএর মতো গ্রহের জন্য ‘বাস্তবসম্মত’ নয়।
ওয়েলব্যাংকস বলেন, ‘এক মাসে—নতুন কোনো তথ্য, মডেল বা পরীক্ষাগার ফলাফল ছাড়াই—তাদের পুরো বিশ্লেষণ বদলে গেল।’
‘আমরা সবচেয়ে কাছাকাছি এসেছি’
যখন দূরবর্তী কোনো গ্রহ তার নক্ষত্রের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে, তখন টেলিস্কোপে সেই নক্ষত্রের আলো বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ভেঙে পড়ে এবং বিজ্ঞানীরা গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে থাকা অণু শনাক্ত করতে পারেন। এই সপ্তাহে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাফায়েল লুকেকুর নেতৃত্বে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ওয়েবের কাছ থেকে প্রাপ্ত ইনফ্রারেড আলোর তথ্য বিশ্লেষণেও ডিএমএস বা ডিএমডিএসুএর কোনো পরিসংখ্যানিক তাৎপর্য পাওয়া যায়নি।
এর আগে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেক টেলর একটি সাধারণ পরিসংখ্যানিক বিশ্লেষণ করে বলেন, কোনো শক্তিশালী বায়োসিগনেচারের প্রমাণ মেলেনি। তবে এমনকি গ্রহটিতে ডিএমএস থাকলেও সেটিই প্রাণের উপস্থিতির প্রমাণ নয়—কারণ এটি প্রাণহীন গ্রহাণু থেকেও পাওয়া গেছে।
তবুও অনেক গবেষক মনে করেন, ভবিষ্যতে মহাকাশ টেলিস্কোপের মাধ্যমে সত্যিকারের ভিনগ্রহবাসীর অস্তিত্ব শনাক্ত করা সম্ভব হবে। ওয়েলব্যাংকস বলেন, ‘এ পর্যন্ত যতটুকু এগিয়েছি, এর চেয়ে কাছাকাছি আর কখনো যাইনি।’ তবে নিকসন বলেন, ‘বিদ্যমান কাঠামো অনুসরণ করে, ধাপে ধাপে প্রমাণ গড়ে তুলতে হবে, এক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছে তেমন অবৈজ্ঞানিক তাড়াহুড়া করে নয়।'
সূত্র: এএফপি
এসজেড