দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রধান প্রার্থীরা দেশের অস্তিত্ব ও আত্মার জন্য এক নির্ণায়ক লড়াই হিসেবে উপস্থাপন করছেন। তবে যেই জয়ী হোন না কেন, তাকে একটি গভীরভাবে বিভক্ত সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। গত বছর সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওলের বিতর্কিত সামরিক শাসন জারির ঘোষণার পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার দেগু থেকে এএফপি জানায়, সব প্রধান জনমত জরিপ অনুযায়ী, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির লি জে-মিয়ং এগিয়ে রয়েছেন এবং ডানপন্থী পিপল পাওয়ার পার্টির (পিপিপি) কিম মুন-সু অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। রক্ষণশীলতার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত দেগু শহর থেকে শুরু করে বামপন্থীদের আধ্যাত্মিক ঘাঁটি গাওয়াংজু পর্যন্ত, এএফপি ভোটারদের সঙ্গে তারা কোথায় দাঁড়িয়ে এবং দেশের বিভাজন কীভাবে নিরাময় করা যেতে পারে এ নিয়ে কথা বলেছে।
পক্ষ বদলের গল্প
দেগু শহরের এক বিনোদন পেশাজীবী এবং দীর্ঘদিনের রক্ষণশীল ভোটার লি উ-হিউন বলেন, সামরিক শাসনের ঘটনায় তিনি ‘গভীরভাবে আলোড়িত’ হয়েছেন। ৪৫ বছর বয়সী লি বলেন, ‘আমার বাবা-মা এবং বয়স্কদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, তারা ধীরে ধীরে রক্ষণশীলদের প্রতীক ‘লাল রঙ’ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। অনেকে ভাবতে পারেন, একটি ঘটনা কীভাবে আমার রাজনৈতিক অবস্থান পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ঠিক তা-ই হয়েছে। ৪০ বছর বয়সী অনেকেই এখন মনে করেন, যা ঘটেছে তা ঠিক হয়নি।’
প্রজন্মগত ফাটল
দেগুরই এক ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী কো সিউং-জু বলেন, তরুণ ভোটাররা এখন আর চোখ বন্ধ করে রক্ষণশীলদের সমর্থন করছেন না। তার ভাষায়, ইউন প্রশাসনের গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেট কাটার সিদ্ধান্ত বিজ্ঞান ও প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। ‘সত্যিই চাই এই বাজেট আবার ফিরিয়ে আনা হোক।’
‘সন্তুলন জরুরি’
৬০ বছর বয়সী সাবেক গাড়িশিল্প কর্মী কিম সুং-গিউন এখনো সিদ্ধান্তহীন। তিনি বলেন, ইউনের সামরিক শাসনের চেষ্টা ছিল ‘চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি। মানুষের জীবন এমনিতেই খুব কঠিন।’ তবে তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির সংসদে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘সন্তুলন জরুরি।’ তার মতে, আঞ্চলিক আনুগত্য নয়, যিনি জনগণকে অগ্রাধিকার দেবেন তাকেই ভোট দেওয়া উচিত।
অটল অবস্থান
একজন দোকানদার কিম বলেন, সামরিক শাসন ঘোষণাকে ভুল মনে করলেও তাতে কিছু ঘটেনি—তাই বিষয়টি ‘এড়িয়ে চলাই ভালো’। ৬৯ বছর বয়সী কিম বলেন, কোভিড-১৯ মহামারিতে স্থানীয় অর্থনীতি ‘ধ্বংস’ হয়ে গেছে এবং এখনও পুনরুদ্ধার হয়নি।
গণতন্ত্রের পক্ষে ভোট
গাওয়াংজুর ৭৯ বছর বয়সী বাসিন্দা লি গুই-নিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টি ও তাদের প্রার্থী লি জে-মিয়ংয়ের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছেন।তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র আমাদের স্বাধীন ও নিরাপদে বাঁচার অধিকার দেয়। কিন্তু পিপিপির মতো দলগুলোকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বলে মনে হয় না।’ গণতন্ত্র মানে তার কাছে ‘স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা ও মানসিক শান্তি নিয়ে চলাফেরা করা।’
‘ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ’
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা জাং সে-ইউন (৬৫) বলেন, তিনি কেবল দলীয় আনুগত্যে ভোট দেন না। তবে ১৯৮০ সালে গাওয়াংজুতে সামরিক সরকারের দমন-পীড়নের ভয়াবহতা এখনো তার মনে দাগ কেটে আছে। ‘সেই অভিজ্ঞতা এখনো মনে বাজে। এ কারণেই আমি বলি—ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি মনে করেন, এই নির্বাচন হওয়া উচিত ‘একটি সন্ধিক্ষণ’। বললেন, ‘যদি আমরা এই সুযোগ হারাই, তাহলে হয়তো দেশকে ঘুরে দাঁড়াতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।’
দলীয় পরিচয়ের বাইরে
ইংরেজি শিক্ষিকা হেইলি লি গাওয়াংজুর ভোটারদের আহ্বান জানিয়েছেন নিজেদের নৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে ভোট দেওয়ার জন্য।তিনি বলেন, ‘অনেক রাজনীতিবিদেরই সাধারণ মানুষের কথা শোনার মানসিকতা নেই। তারা অনেকেই উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে এসেছেন।’
মধ্যপন্থার চাপে
গাওয়াংজুর সামাজিক উদ্যোগে কর্মরত ৬৪ বছর বয়সী পার্ক ইয়ন-ওক বলেন, তিনি নিজেকে মধ্যপন্থী পরিচয় দিলে অনেক সময় প্রশ্নের মুখে পড়েন। ‘অনেকে বলেন, আপনি যদি ডেমোক্রেটিক পার্টিকে সমর্থন না করেন, তাহলে পিপিপিকে করছেন?—এই ধরনের প্রতিক্রিয়া খুব সাধারণ।’ তার মতে, পিপিপি প্রার্থী কিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হতে পারেন।
সূত্র: এএফপি
এসজেড