করোনা-পরবর্তী সময়ের অন্যতম বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ। টানা তিন অর্থবছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির নিম্নহার মিলিয়ে অর্থনীতিতে অস্থিরতা স্পষ্ট। তবে এর মধ্যেও কিছু সূচকে এসেছে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা। গতকাল ঘোষিত ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেট এই সংকট-স্থিতিশীলতার দ্বৈত বাস্তবতায় পেশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ৩.৯৭ শতাংশ, যা গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন (করোনা মহামারীকালীন ২০১৯–২০ অর্থবছর ব্যতীত)। কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ১.৭৯ শতাংশ, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। শিল্প খাতে কিছুটা উন্নতি থাকলেও সেবা খাতেও প্রবৃদ্ধি কমেছে।
বিনিয়োগ ও সঞ্চয়ে নেতিবাচক প্রবণতা
বিনিয়োগের হার কমে এসেছে ২৯.৩৮ শতাংশে, যা ২০১৩–১৪ অর্থবছরের পর সর্বনিম্ন। পাশাপাশি মোট দেশজ সঞ্চয় কমছে ধারাবাহিকভাবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি একটি গুরুতর সংকেত—দেশের মানুষ ও প্রতিষ্ঠান আয় করলেও তা সঞ্চয় না করে খরচ করছে বেশি, যার পেছনে রয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থানের ঘাটতি।
মূল্যস্ফীতি, আয় ও দারিদ্র্য
টানা তিন অর্থবছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি, যা ১৯৮৬ সালের পর প্রথম। ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে, কারণ মজুরি বৃদ্ধির হার ৩৯ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা করছে, চলতি পরিস্থিতিতে ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে চরম দারিদ্র্যে পড়তে পারে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ মাসে ৬০ হাজারের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, এবং শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার কমেছে, বিশেষ করে নারীদের মধ্যে। সেবা, কৃষি ও শিল্প—সব খাতেই কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে।
আর্থিক খাত ও বৈদেশিক খাতের মিশ্র চিত্র
আর্থিক খাত এখনো ভঙ্গুর। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ব্যাংক নাজুক অবস্থায় রয়েছে, খেলাপি ঋণ বেড়েছে। পাশাপাশি, বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে ৭.৫৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা বিনিয়োগ কমে যাওয়ার বড় সূচক।
তবে বৈদেশিক খাতে কিছু ইতিবাচক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি রয়েছে, টাকার মান কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে এবং রিজার্ভেও ধস থেমেছে। হুন্ডি কমে যাওয়ায় প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
বর্তমান অর্থবছরের বাজেট এমন এক সময়ে পেশ হয়েছে, যখন আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন হলে বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সময় থাকবে মাত্র ছয় মাস, আর যদি জুনে নির্বাচন হয়, তাহলে পুরো বাজেট বাস্তবায়নের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর পড়বে।
নীতি পরিবর্তন ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে, এবং বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। ডলারের দর গত ৯ মাসে ১১৮ টাকা থেকে বেড়ে ১২২ টাকায় পৌঁছেছে। এ পদক্ষেপ সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরিয়েছে, তবে এর প্রতিফলন এখনো সাধারণ মানুষের জীবনে দেখা যায়নি।
অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “অর্থনীতি বহির্বাণিজ্য খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা পেয়েছে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ আর্থিক কাঠামোতে সংকট রয়ে গেছে।” তাঁর মতে, বাজেট বাস্তবায়নে ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংযমী হওয়া এবং ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগে আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।
তিনি আরও বলেন, “নগদ প্রবাহ সংকটে সরকার যদি আবার গোপনে টাকা ছাপানো শুরু করে, তবে সেটি পুরো স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করে দিতে পারে। এখন মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই স্থিতিশীলতাকে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিতে রূপান্তর করা।”
thebgbd.com/NIT