রঙিন স্কুলব্যাগে ভরা একটি কক্ষ। কোনোটা গোলাপি, কোনোটা বেগুনি, কারোটা আবার কালো বা লাল। প্রতিটি ব্যাগের ভেতরে রাখা আছে বই, খাতা, কলম, ছোট্ট টিফিন বক্স, পানির বোতল আর হয়তো মায়ের ছোঁয়ার উষ্ণতা। প্রতিটি ব্যাগে ঝোলানো একটি কাগজ—শ্রেণি, নাম আর কোড নম্বর লেখা। বাতাসে দুলছে সেই কাগজ, যেন কাঁপছে স্মৃতির পাতাগুলো।
২১ জুলাই সকালে এগুলো কাঁধে নিয়ে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এসেছিল ছোট ছোট শিশুরা। কে জানতো এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সবকিছু পাল্টে যাবে।
এখন কেউ হাসপাতালের বেডে, কেউ আতঙ্কে অস্ফুটস্বরে কথা বলছে। আর ফেলে যাওয়া ব্যাগগুলো পড়ে আছে, জড়াজড়ি করে, নিশ্চুপ সাক্ষী হয়ে।
গতকাল শনিবার মাইলস্টোন স্কুলের ক্যাম্পাসে দেখা যায় এই শোকাবহ দৃশ্য। এক পাশে টিনশেডের নিচে দুটি কক্ষ—একটিতে কিছু পরীক্ষার্থীকে কাউন্সেলিং করানো হচ্ছে, আরেকটির মেঝেতে সারি সারি ব্যাগ পড়ে আছে। প্রায় ৭০টির মতো। ওই দিন আগুন লাগার সময় অনেক শিক্ষার্থী ব্যাগ ফেলে প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দেয়। কেউ কেউ আর ফিরেও আসেনি।
শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ জীবিত থাকলেও মন ভেঙে গেছে অনেকের। ব্যাগ নিতে আসা অভিভাবকরা ব্যাগ হাতে নিয়েই ভেঙে পড়ছেন কান্নায়।
যেমন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী নূরী জান্নাতির খালা ইসরাত জাহান ও তাসলিমা বেগম ব্যাগ খুঁজছিলেন। ইসরাত জাহান বললেন, ‘এই ব্যাগটা দিয়াবাড়ীর বাসায় ফেরার জন্য ছিল, এখন জান্নাতি শুয়ে আছে বার্ন ইউনিটে, সারা শরীর জ্বলছে।’
জান্নাতিকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করেন তার ভাই রুহান। আগুন লাগার পরপরই কলেজ ভবন থেকে ছুটে এসে বোনকে বের করে নিয়ে যান হাসপাতালে।
জান্নাতির খালা তাসলিমা জানান, তার মেয়ে ফাতেমা তখন ক্লাস শেষ করে ক্যান্টিনের পাশে ছিল। ঠিক তখনই বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। ধুলা-বালিতে ভরে যায় তার শরীর, অল্প তাপে ঘাড় পুড়ে যায়। সে এখন ভয় পায়—স্কুলের নাম শুনলেও কেঁপে ওঠে, কোনো শব্দ শুনলেও আঁতকে ওঠে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় ৩৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৫০ জন।
স্কুল খুলছে না আজও
দুর্ঘটনার পর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাঁচটি ক্যাম্পাসই বন্ধ ঘোষণা করা হয়। যদিও আজ রোববার চারটি ক্যাম্পাস খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল, শেষ পর্যন্ত তা স্থগিত করা হয়েছে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতি বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম জানান, ‘শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা বিবেচনায় দিয়াবাড়ী ক্যাম্পাসে তাদের কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এখনই তাদের চাপ দিয়ে ক্লাসে ফেরানো সঠিক হবে না।’
একজন কাউন্সেলর বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা এখনো আতঙ্কগ্রস্ত। চোখ বন্ধ করলেই আগুন, ধোঁয়া আর চিৎকারের দৃশ্য ফিরে আসে। পড়ার প্রতি মনোযোগ নেই, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সময় লাগবে।’
একটি দুর্ঘটনা পতন শুধু একটি ভবনকে ধ্বংস করেনি, বরং শতশত শিশুর কোমল মনে নামিয়ে এনেছে ভয় ও বিষাদের অন্ধকার। ব্যাগের ভেতর রাখা বইগুলো আবার কখন খুলবে? শিশুরা কবে আবার নির্বিঘ্নে স্কুলে ফিরবে? সময়ই হয়তো বলবে উত্তর।
thebgbd.com/NA