ইসলামের ইতিহাসে ফিলিস্তিন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এই অঞ্চলকে বরকতময় আখ্যা দিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পবিত্র মহিমাময় তিনি, যিনি তার বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করালেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমরা দিয়েছি বরকত, যেন আমরা তাকে আমাদের নিদর্শন দেখাতে পারি; তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ১)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘আর তাকে (হজরত ইবরাহিম আ.) ও লুতকে উদ্ধার করে সেই ভূখণ্ডের দিকে নিয়ে গেলাম, যেখানে বিশ্ববাসীর জন্য বরকত রেখেছি।’ (সুরা আম্বিয়া: ৭১)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিররা বলেন, সেই ভূখণ্ড বলে শাম (বর্তমানে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন) দেশকে বোঝানো হয়েছে। যাকে শস্য-শ্যামলতা, ফলমূল, নদ-নদীর আধিক্য ও সেই সঙ্গে বহু নবীর বাসস্থান হওয়ার কারণে বরকতময় ও কল্যাণময় বলা হয়েছে।
ফিলিস্তিনকে বলা হয় নবী-রাসুলদের ভূমি। ইবরাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, ইউসুফ, লুত, দাউদ, সুলাইমান, জাকারিয়া, ইয়াহিয়া ও ঈসা আলাইহিমুস সালামসহ বহু নবীর মোবারক পদধূলিতে ধন্য ফিলিস্তিনের মাটি। হজরত উবাদাহ ইবনুস সামিত, শাদ্দাদ বিন আউস, ওয়াসিলাহ ইবনুল আসকা, আউস ইবনুস সামিত রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ সাহাবী শেষ জীবনে ফিলিস্তিনে বাস করেছেন।
মূলত ওমর (রা.)-এর যুগে জেরুজালেম বিজয়ের পর এখানে সাহাবিদের পদচারণ শুরু। দ্রুত সময়ে অঞ্চলটি আলেমদের উর্বর ভূমি হিসেবে পরিচিতি পায়। এই ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেন আরও অসংখ্য দ্বীনি ব্যক্তিত্ব। ইসলামের ইতিহাসে যাদের অবদান চিরস্মরণীয়। ফিলিস্তিন অঞ্চলে জন্ম নেওয়া কয়েকজন বিখ্যাত আলেমের পরিচয় এখানে তুলে ধরা হলো—
ইমাম ইবনে কুদামাহ (রহ.) (মৃত্যু: ৬২০ হি.)
হাম্বলি মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম আবদুল্লাহ বিন আহমদ ইবনে কুদামাহ (রহ.) ৫৪১ হিজরিতে ফিলিস্তিনের নাবলুসের জামমাইন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৫ খণ্ড বিশিষ্ট ফিকাহবিষয়ক সর্ববৃহৎ গ্রন্থ আল-মুগনি রচনা করেছেন। ১১৪৭ সালে ফ্রান্সের রাজা সপ্তম লুই ও জার্মানির রাজা তৃতীয় কনরাডের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ক্রুসেড শুরু হয়। তখন তাঁর বাবা আহমদ ইবনে কুদামাহ পরিবার নিয়ে দামেস্কে চলে যান এবং সেখানেই ইবনে কুদামাহ পড়াশোনা করেন। শায়খ আবদুল কাদির জিলানিসহ বাগদাদে অনেক মুহাদ্দিসের কাছে তিনি হাদিস ও ফিকাহ পাঠ করেন। ইবনে কুদামাহ ও আবদুল গনি আল-মাকদিসি সম্পর্কে খালাতো ভাই ছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল ছয় মাস। হাম্বলি মাজহাবে উভয়ের গুরত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ৫৮৩ সালে সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.)-এর নেতৃত্বে ফিলিস্তিন উদ্ধার অভিযান শুরু হলে ইবনে কুদামাহ মুসলিম সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ২৭ রজব বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয় পর্যন্ত তাতে অংশ নেন। ৬২০ হিজরির ঈদুল ফিতরের দিন তিনি দামেস্ক শহরে ইন্তেকাল করেন।
ইমাম আল-মাকদিসি (রহ.) (মৃত্যু: ৬০০ হি.)
ইমাম আবদুল গনি আল-মাকদিসি ফিলিস্তিনের নাবলুসের জামমাইন শহরে ৫৪১ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান বাইতুল মুকাদ্দাসের নিকটবর্তী হওয়ায় তাঁকে আল-মাকদিসি বলে সম্বোধন করা হয়। ইবনে কুদামাহ (রহ.)-এর ভাই শায়খ মুহাম্মদ বিন ইবদেন কুদামাহ ছিলেন তাঁদের পারিবারিক অভিভাবক। তাই অল্প বয়স থেকেই তাঁর ইলমচর্চা শুরু হয়। তিনি দীর্ঘকাল যাবৎ দামেস্ক, ইস্কান্দারিয়া, বাইতুল মুকাদ্দাস, মিসর, বাগদাদ, হাররান, মসুল, ইস্পাহান, হামজানসহ অসংখ্য শহরে সফর করেছেন। শায়খ আবুল মাকারিম বিন হিলাল, সালমান বিন আলি আল-রাহবি ও আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ বিন হামজাহ আল-কুরাশি, আবদুল কাদির আল-জিলানি (রহ.)-সহ অনেক বিখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিসের কাছ থেকে তিনি হাদিস ও ফিকাহ সংক্রান্ত ইলম অর্জন করেছেন। পরে তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে দামেস্কে চলে যান। সেখানকার কাসইউন পর্বতে প্রথম মাদরাসা নির্মাণ করেন, যা আল-মাদরাসা আল-উমারিয়্যাহ নামে পরিচিত। তাঁর পরিবারের সদস্যরা জীবনযাপনে অত্যন্ত সৎ ও বিদ্যানুরাগী হওয়ায় স্থানটি সালেহিয়্যাহ নামে পরিচিতি লাভ করে। উমদাতুল আহকাম, আল-কামাল ফি আসমাইর রিজাল, আল-মিসবাহসহ হাদিসসংক্রান্ত অনেক গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। ৬০০ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। মিসরের কারাফাহ নামক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
ইমাম তাবরানি (রহ.) (মৃত্যু: ৩৬০ হি.)
প্রখ্যাত ইমাম ও মুহাদ্দিস সুলায়মান বিন আহমদ আল-তাবরানি (রহ.) ২৬০ হিজরিতে ফিলিস্তিনের প্রাচীন নগরী আক্কা (বর্তমানে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় একটি শহর) জন্মগ্রহণ করেন। শামের তাবরিয়া এলাকার দিকে সম্পৃক্ত করে তাঁকে তাবরানি বলা হয়। বাবার অনুপ্রেরণায় তিনি শৈশব থেকেই ইলম চর্চা শুরু করেন এবং আমৃত্যু তা অব্যাহত রাখেন। তিনি দীর্ঘ ১৬ বছর যাবৎ হারামাইন, ইয়েমেন, মাদায়েন, শাম, মিসর, বাগদাদ, কুফা, বসরা, ইস্পাহানসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে হাদিস বর্ণনাকারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁদের জীবনী সংকলন করেন। এ বিষয়ে তিনি শতাধিক খণ্ডের অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই কাজের জন্য পৃথিবীর নানা প্রান্তে তিনি ভ্রমণ করেছেন। ৩৬০ হিজরিতে ১০০ বছর বয়সে তিনি ইস্পাহান শহরে ইন্তেকাল করেন। আল-মুজামুস সাগির, আল-মুজামুল আওসাত, আল-মুজামুল কাবিরসহ অনেক বিখ্যাত গ্রন্থ রয়েছে তাঁর।
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) (মৃত্যু: ২০৪ হি.)
ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদরিস আল-শাফেয়ি (রহ.) ১৫০ হিজরিতে ফিলিস্তিনের গাজা বা আসকালান অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। দুই বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে মক্কায় যান এবং পবিত্র কোরআন হিফজ করেন। এরপর ১০ বছর বয়সে প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থ মুয়াত্তা মুখস্থ করেন। ২০ বছরের কম বয়সেই তিনি ফতোয়া দেওয়ার অনুমোদন লাভ করেন। মদিনায় গিয়ে ইমাম মালিক বিন আনাস (রহ.)-এর কাছে হাদিস শিক্ষা লাভ করেন। বাগদাদে তিনি ইমাম মুহাম্মদ বিন আল-হাসান আল-শায়বানি (রহ.)-এর কাছে হানাফি ফিকাহ শিক্ষা করেন। ফিকাহ, উসুলে ফিকাহ, হাদিস ও তাফসির বিষয়ে তাঁর অগাধ দক্ষতা রয়েছে। তিনি প্রসিদ্ধ চারটি মাজহাবের একটি শাফেয়ি মাজহাবের ইমাম। ২০৪ হিজরিতে মিসরে তিনি ইন্তেকাল করেন।
রজা বিন হায়াওয়াহ (রহ.) (মৃত্যু: ১১২ হি.)
প্রখ্যাত তাবেঈ রজা বিন হায়াওয়াহ (রহ.) ছিলেন ফিলিস্তিন অঞ্চলের বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও উমাইয়া খিলাফতের মন্ত্রী। তিনি বিসয়ান (বর্তমানে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি জেলা) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে বাবার সঙ্গে শাম বিজয়ী প্রখ্যাত সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল (রা.)-এর কাছে এলে তিনি তাঁকে কোরআন পড়াতে বলেন। তিনি উবাদা বিন সামিত, মুয়াজ বিন জাবাল, আবু দারদা, উম্মে দারদা (রা.)-সহ অনেক সাহাবির কাছে হাদিস ও ফিকাহ শিক্ষা লাভ করেন। তাঁকে শাম ও ফিলিস্তিন অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ আলেমদের মধ্যে গণ্য করা হত। তিনি শুধু ইবাদতে নিমগ্ন হয়ে ক্ষান্ত হননি, জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন কাজও করতেন।
রাষ্ট্রপ্রধানদের পরামর্শ দিতেন, মানুষের ঐক্য তৈরি করতেন এবং জিহাদে অংশ নিতেন। দ্বিন পালন, গভীর ইলম ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার গুণে তিনজন উমাইয়া খলিফার মন্ত্রী ও উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। তাঁরা হলেন ওমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.), আবদুল মালিক বিন মারওয়ান (রহ.), সুলায়মান বিন আবদুল মালিক (রহ.)। মূলত তাঁর পরামর্শে ওমর বিন আবদুল আজিজকে খলিফা নিযুক্ত করা হয়েছিল। তাঁর তত্ত্বাবধানে খলিফা আবদুল মালিকের যুগে পবিত্র মসজিদুল আকসা প্রাঙ্গণে কুববাতুস সাখরাহ নির্মিত হায়। ১১২ হিজরিতে তাঁর ইন্তেকাল হয়।