সেই ১৯৯২ সালে অযোধ্যার মাটি থেকে বাবরির স্তম্ভে প্রথম আঘাত হানে কর সেনারা। কালের সরনি বেয়ে সেখানে বাবরির অস্তিত্ব চিরতরে মুছে এখন গড়ে উঠেছে রাম মন্দির। এবার মোদি সরকারের জমানায় এনসিইআরটি-এর রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সিলেবাস থেকেও মুছে দেওয়া হল বাবরির অস্তিত্ব। কার্যত এমনভাবেই যেন কোনও কালে বাবরি নামে কোনও মসজিদ ছিল না অযোধ্যায়।
দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বইতে বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গে লেখা ছিল ষোলশো শতাব্ধীতে মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মির বাকি এই মসজিদ নির্মাণ করেন। তবে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের অধীন স্বশাসিত সংস্থা এনসিইআরটি-এর তরফে যে নয়া সিলেবাস প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে বাবরি মসজিদের নাম মুছে দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, এটি ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি কাঠামো। যা ১৫২৮ সালে শ্রীরামের জন্মস্থানের উপর তৈরি করা হয়, যদিও এই কাঠামোর ভেতরে ও বাইরে হিন্দুদের নানা চিহ্ন ও প্রতীক স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাওয়া যায়।
এখন যেখানে অযোধ্যার রামমন্দির, সেখানে আগে কী ছিল? উত্তর বাবরি মসজিদ নয়। এনসিইআরটি-র নতুন পাঠ্যপুস্তক বলছে, ‘‘সেখানে ছিল তিনটি গম্বুজওয়ালা এক স্থাপত্য। যা ১৫২৮ সালে তৈরি করা হয় রামের জন্মস্থলে। যার দেওয়াল জুড়ে ছিল হিন্দু ধর্মের প্রতীক এবং হিন্দু পুরাণের নিদর্শনের ছড়াছড়ি।’’
দিন সাতেক আগেই প্রকাশিত হয়েছে এনসিইআরটি (ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং)-এর দ্বাদশ শ্রেণির এই ‘সংশোধিত’ পাঠ্যপুস্তিকা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ে চোখে পড়ার মতো সংশোধনী আনা হয়েছে অযোধ্যার অধ্যয়ে। পুরনো বইয়ে অযোধ্যার ইতিহাসের যে বিবরণ ছিল চার পাতা জুড়ে, নতুন বইয়ে তা শেষ করে দেওয়া হয়েছে দু’পাতাতেই। বাদ গিয়েছে বাবরি মসজিদ নাম। এবং আরও অনেক কিছু।
এনসিইআরটি হল কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বয়ংশাসিত সংস্থা।
তাদের নতুন সংশোধিত অযোধ্যার ইতিহাসে বাদ দেওয়া হয়েছে, ১৯৮৬ সালে মসজিদের তালা খোলার পর আদালতের নির্দেশে দুপক্ষকেই তাদের ধর্মীয় আচার পালনের অনুমতি দেওয়া কথা। এই মসজিদ ঘিরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। বিজেপির গুজরাটের সোমনাথ থেকে অযোধ্যা রথযাত্রার কথা, ১৯৯২ সালে বাবরি ধ্বংসে করসেবকদের ভূমিকা, ১৯৯৩ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙা, তৎকালীন বিজেপিশাসিত রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়া এমনকি, বিজেপি সরকারের অনুশোচনামূলক বিবৃতিও। এমনকী এই মসজিদ ধ্বংসের জন্য উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংয়ের সরকারকে ভর্ৎসনার বিষয়টি পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে। এর কোনওটিরই উল্লেখ নেই নতুন বইয়ে।
বদলে লেখা হয়েছে, ১৯৮৬ সালে ওই তিন গম্বুজ বিশিষ্ট স্থাপত্যের তালা খোলার পর যখন সেখানে কিছু মানুষকে প্রার্থনার অনুমতি দেয় ফৈজাবাদ আদালত, তখন হিন্দুরা অবহেলিত বোধ করেন। বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘‘হিন্দুরা মনে করেন, রাম জন্মভূমি এবং ভগবান শ্রীরামকে নিয়ে তাদের আবেগকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অন্য দিকে মুসলিম সম্প্রদায় চেয়েছে ওই স্থাপত্যের উপর তাদের অধিকার কায়েম করতে।’’
যদিও এনসিআরটিইর বক্তব্য, এই সবই করা হয়েছে পড়ুয়াদের সামনে ইতিহাসের ইতিবাচক বিষয়টি তুলে ধরার জন্য। সাম্প্রদায়িক ‘অশান্তি’র কথা দেশের ভবিষ্যতকে জানানোর প্রয়োজন নেই বলেই মনে করছে তারা।
এনসিইআরটির পাঠ্যক্রম মেনে চলে সিবিএসই বোর্ড। আইসিএসই এবং আইএসই বোর্ডও কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে চলে। এই দুই বোর্ডের পড়ুয়াদের জন্যই নির্ধারিত দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে অযোধ্যার অধ্যায়ে ফলাও করে লেখা হয়েছে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের রায়ের কথা। অথচ পুরনো বইয়ে যেখানে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য ১৯৯২ সালে তৎকালীন উত্তরপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহের সরকারকে আদালতের ভর্ৎসনার কথা লেখা ছিল, তা বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে দু’টি সংবাদপত্রের ছবিও। যার একটির শিরোনামে লেখা ছিল, ‘‘বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য কল্যাণ-সরকারকে বরখাস্ত করা হল’’। অন্যটির শিরোনামে ছিল বাজপেয়ীর বক্তব্য। যেখানে তিনি বলছেন, ‘‘অযোধ্যা হল বিজেপির সবচেয়ে বড় ভুল’’।
বাদ গিয়েছে সেই সব কিছু। সে সব পুরোপুরি মুছে নয়া পাঠ্যে বলা হয়েছে, ওই ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট কাঠামোর তালা খোলার পর সেখানে পুজোর অনুমতি দেয় আদালত। যে বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে। কারণ, মনে করা হত ওই কাঠামো মন্দির ভেঙে তৈরি করা হয়। যা নিয়ে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। যার প্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালে ওই কাঠামো ভেঙে দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এই ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টের রায়। যেখানে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে এই বিষয়ে রায় ঘোষণা করে দেশের শীর্ষ আদালত। যেখানে হিন্দুপক্ষের দাবিকে মান্যতা দিয়ে আদালতের তরফে নির্দেশ দেওয়া হয় ওই স্থানে মন্দির গঠনের। ওই বছরই মন্দির গঠনের কাজ শুরু হয় ওই স্থানে।
রয়েছে শীর্ষ আদালতের সাম্প্রতিক রায়। যেখানে আদালতের বেঞ্চ বলছে, ‘‘যে কোনও সমাজেই দ্বন্দ্ব বা সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু যে দেশে বহু জাতির বাস, সেখানে এই ধরনের সংঘাতের সমাধান হয় আইনি প্রক্রিয়ায়। দেশের সংবিধান সর্বধর্ম এবং বিশ্বাসের মানুষের প্রার্থনা করার অধিকারকে সম্মান করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অযোধ্যায় মসজিদ তৈরির অনেক আগে থেকেই ওই এলাকার সঙ্গে হিন্দুদের রাম জন্মভূমির বিশ্বাস জড়িয়ে ছিল। তার প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে।’’
বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদ তৈরির জন্য দেওয়া হয়েছে আলাদা জমি। আর এই সিদ্ধান্ত সমাজের অধিকাংশ মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছেন। স্পর্শকাতর একটি বিষয়কে কী ভাবে দু’পক্ষের সম্মতিক্রমে গণতান্ত্রিক ভাবে সমাধান করা যায়, তার ধ্রুপদী উদাহরণ হল অযোধ্যার রায়।’’
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের পর এই নিয়ে চতুর্থ বার সংশোধন করা হল এনসিইআরটির দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক।