যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন। বিশ্বের দুই ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ দেশ। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তাই লেগেই আছে ওয়াশিংটন এবং বেইজিংয়ের মধ্যে। কখনও তাইওয়ান ইস্যু, কখনও বাণিজ্যিক প্রসার— নানা সময়ে নানা কারণে এই দুই দেশের মধ্যেকার সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সম্প্রতি চীনের সঙ্গে সংঘাতে অন্য একটি ইস্যুতে নজর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বার করে ফেলেছে লুকানো ‘তুরুপের তাস’। পরিস্থিতি এমনই, জো বাইডেনের একটি স্বাক্ষরের উপর ঘটনার গতিপ্রকৃতি নির্ভর করছে। বাইডেনকে স্বাক্ষর না করার অনুরোধও জানিয়েছে চীন।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ইস্যু তথা এই ‘তুরুপের তাস’ আসলে তিব্বত। যে পাহাড়ি ভূখণ্ড দীর্ঘ দিন ধরে চীনের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে রয়েছে। তিব্বত চীনের মধ্যে থেকেই নিজেকে স্বতন্ত্র প্রশাসন হিসাবে ঘোষণা করে এসেছে। যদিও চীন না মানতে নারাজ। তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামা ১৯৫৯ সালে চান থেকে পালিয়ে ভারতে এসে আশ্রয় নেন। সেই থেকে তিনি হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় থাকেন এবং সেখান থেকেই ‘স্বতন্ত্র’ তিব্বতের কাজ পরিচালনা করেন।
তিব্বত ইস্যু নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র নতুন একটি বিল এনেছে। মার্কিন কংগ্রেসে ইতিমধ্যে সেই বিল পাশও হয়ে গিয়েছে। তিব্বত-চীন বিতর্ক আইন বা ‘রিস্লভ তিব্বত অ্যাক্ট’ আনতে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। কংগ্রেসে পাশ হলেও এই বিলে এখনও সই করেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। তার স্বাক্ষর পেলেই বিল আইনে পরিণত হবে। যা একেবারেই চাইছে না চীন। তাই স্বাক্ষর না করার জন্য তারা বাইডেনকে অনুরোধও করেছে।
কী এমন আছে আইনে, যা বন্ধ করার জন্য সুর নরম করছে চীন? ‘রিস্লভ তিব্বত অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, তিব্বত নিয়ে চীনের যাবতীয় ‘ভুল তথ্যের’ সরাসরি বিরোধিতা করবে যুক্তরাষ্ট্র। তার জন্য অর্থও ব্যবহার করবে।
চীন প্রথম থেকেই বলে এসেছে, তিব্বত তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নতুন আইন অনুযায়ী, সেই বক্তব্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করবে যুক্তরাষ্ট্র। সেই সঙ্গে দালাই লামা এবং তিব্বতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনার জন্য বেইজিংকে অনুরোধও করা হবে। তিব্বতের মানুষের বহুমুখী সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়, বিশেষ করে তাদের ‘স্বতন্ত্র ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং ভাষাগত পরিচয়’কে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এই আইনে।
এখানেই শেষ নয়, আইনে স্বতন্ত্র তিব্বতের ভৌগোলিক অবস্থান নিশ্চিত করতে ‘টিবেটান পলিসি অ্যাক্ট’ নামক আইন সংশোধনের কথাও বলা হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসে তিব্বত সংক্রান্ত এই বিল পাশের পরেই আমেরিকার বেশ কয়েক জন আইনজীবী ভারতে আসেন। ধর্মশালায় দালাই লামার সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে আলোচনা করাই তাদের উদ্দেশ্য বলে জানান তারা।
তিব্বত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা এবং এই বিল পাশের পর চীনে শোরগোল শুরু হয়েছে। অনুরোধের পাশাপাশি হুঁশিয়ারিও দিয়েছে বেইজিং। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান জানিয়েছেন, বাইডেন বিলে সই করলে বেইজিং কড়া পদক্ষেপ সিতে বাধ্য হবে। চীনা মুখপাত্র বলেন, ‘‘চতুর্দশ দালাই লামা আদৌ বিশুদ্ধ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব নন। তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং চীনবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত। এই সংক্রান্ত যে রিপোর্ট পাচ্ছি, তা নিয়ে বেইজিং উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ, তারা দালাই গোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবকে চিহ্নিত করুক। বিশ্বকে এ বিষয়ে ভুল বার্তা দেওয়া বন্ধ করুক।’’
লিন আরও বলেন, ‘‘তিব্বত সংক্রান্ত বিষয়গুলি সম্পূর্ণ ভাবে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বহিরাগত কোনও হস্তক্ষেপ সেখানে প্রয়োজন নেই। আমরা শিজ্যাং (তিব্বত প্রদেশকে ওই নামেই পরিচিত করে থাকে চিন)-কে চীনের অংশ হিসাবে মেনে নিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করছি। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপকে প্রশ্রয় না দেওয়ার অনুরোধ করছি। যদি তা করা হয়, তবে বেইজিংও কড়া হবে।’’
উল্লেখ্য, তিব্বত সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিল এই প্রথম নয়। এর আগে ২০০২ সালে ‘টিবেটান পলিসি অ্যাক্ট (টিপিএ)’ এবং ২০২০ সালে ‘টিবেটান পলিসি অ্যান্ড সাপোর্ট অ্যাক্ট (টিপিএসএ)’ এনেছে ওয়াশিংটন। তবে ‘রিস্লভ তিব্বত অ্যাক্টে’ যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি তিব্বতকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করার কথা বলেছে। তিব্বতের স্বাধীনতার সমর্থনে যে কোনও বিদ্রোহকে সাহায্য করার কথা বলেছে। সর্বোপরি, তিব্বতের ইতিহাস নিয়ে চীনের বক্তব্য অস্বীকার করেছে। সেই কারণেই এই আইনকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
চীনের দাবি অনুযায়ী, ৭০০ বছরেরও বেশি সময় চীনের অন্তর্গত তিব্বত। যদিও তিব্বতপন্থীরা বলে থাকেন, দীর্ঘ সময়ে এই ভূখণ্ড স্বাধীন এবং স্বশাসিত ছিল। চীন তা মানতে চায় না। তিব্বত ইস্যুতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপও তারা বরদাস্ত করে না। তিব্বত স্বশাসিত হলেও তাকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের আখ্যা দেওয়া যায় না। কারণ রাষ্ট্র হওয়ার অন্যতম শর্ত নিজস্ব ভূখণ্ড। তিব্বতের ভূখণ্ড এখনও চীনের সীমার মধ্যে পড়ে। স্বশাসিত তিব্বতের শাসন পরিচালনা করেন দালাই লামা। যদিও তাকে চীন স্বীকৃতি দেয় না।
বর্তমানে তিব্বতের পরিচালনায় রয়েছেন চতুর্দশ দালাই লামা। তার আসল নাম তেনজিং গ্যাৎসো। ৮৮ বছরের এই প্রবীণ ধর্মীয় নেতা ১৯৫৯ সালে চীন ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আসেন। সেই থেকে ধর্মশালায় রয়েছেন। ‘স্বশাসিত’ তিব্বতের একতার প্রতীক দালাই লামা।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে চীনের মতানৈক্য রয়েছে। তাইওয়ান ইস্যু নিয়েও গত কয়েক বছরে দফায় দফায় এই দুই দেশের সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়েছে। অনেকের মতে, তাইওয়ান থেকে নজর ঘোরাতেই এ বার চীনকে অন্য ভাবে ব্যস্ত রাখার পরিকল্পনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই কারণে তারা নতুন করে তিব্বতে মনোনিবেশ করেছে। তিব্বতকে কেন্দ্র করে বিশ্বের দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব কোন পথে এগোয়, সেটাই এখন দেখার।