একটি ভুল তথ্য কীভাবে একটি রাষ্ট্রকে বিপদে ফেলে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যুক্তরাজ্য। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সাউথপোর্টের এক নৃত্যকর্মশালায় ছুরিকাঘাতে তিন শিশুর মৃত্যুর পর হামলাকারীর পরিচয় সংক্রান্ত ভুল তথ্যকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সহিংস বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করে। বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভের নিশানা হয়েছে মূলত মুসলিম এবং অভিবাসীরা। খবর বিবিসির।
যদিও এই ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে অ্যাক্সেল মুগানওয়া রুদাকুবানার নামে যে তরুণকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই বলে পুলিশ জানিয়েছে। সাউথপোর্টে গত ২৯ জুলাই আয়োজিত নাচের কর্মশালায় ছুরি হামলার ঘটনায় ওই তিন শিশুর মৃত্যু ছাড়াও আট শিশু এবং দু'জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি গুরুতর জখম হন। আহতরা সঙ্কটজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
ঘটনার পর হঠাতই রটে যায়, হামলাকারী একজন ‘শরণার্থী মুসলিম যিনি নৌকায় চেপে যুক্তরাজ্যে এসেছেন’। এই ভুয়া তথ্যকে কেন্দ্র করে সাউথপোর্টের শোকের আবহাওয়া পরিণত হয় ক্ষোভে, যার আগুন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাজ্যের একাধিক শহরে। ফলে সেখানে দাঙ্গা পরিস্থিতি দেখা দেয়। দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর থেকে সহিংস বিশৃঙ্খলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ক্রমবর্ধমান সহিংসতার তীব্র ভাষায় নিন্দা করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে করা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার। এই ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে অ্যাক্সেল মুগানওয়া রুদাকুবানার নামে যে তরুণকে গ্রেফতার করা হয়েছে, নাম শুনেই বুঝা যায় তিনি মুসলিম নন।
এদিকে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রদর্শন করেন বিক্ষোভকারীদের অনেকেই। দাঙ্গাকারীরা ভাঙচুর চালায়, গাড়িতে এবং শরণার্থীদের আবাসস্থল হিসাবে ব্যবহৃত হোটেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে একাধিক পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই গুরুতর জখম হয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, অতি ডানপন্থী ইংলিশ ডিফেন্স লিগের সমর্থকরা এই সহিংসতার জন্য দায়ী। রদেরহ্যামে শরণার্থীদের আবাসিক এক হোটেলে হামলার নিন্দা জানিয়ে কিয়ের স্টারমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই সহিংস পরিস্থিতির জন্য যারা দায়ী, আইনের পূর্ণ শক্তি দিয়ে তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করা হবে। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে হোটেলে অগ্নিসংযোগসহ অন্যান্য সহিংস ঘটনার নিন্দা করে অভিযুক্তদের হুঁশিয়ার করেন প্রধানমন্ত্রী।
২৯ জুলাই সাউথপোর্টের হার্ট স্ট্রিটে শিশুদের জন্য একটা নৃত্যকর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল যার থিম ছিল 'টেলর সুইফ্ট'। ওই অনুষ্ঠানে ছুরি হামলায় একাধিক শিশু ও দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি গুরুতর আহত হন। এদের মধ্যে তিন শিশু- বেবে কিং (৬), এলসি ডট স্ট্যানকম্ব (৭) ও অ্যালিস দাসিলভা আগুয়ার (৯) নিহত হয়। পালানোর সময় জোয়েল ভেরাইট নামে একজন ব্যক্তিগত প্রশিক্ষকের সঙ্গে এক ঝলক দেখা হয় হামলাকারীর। জোয়েল ভেরাইট স্কাই নিউজকে জানিয়েছেন রক্তাক্ত অবস্থায় এক নারীকে দেখে তিনি সাহায্যের জন্য ছুটে যান এবং হামলাকারীকে ছুরি হাতে দেখতে পান। ঘটনার আকস্মিকতায় শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে শহর।
মঙ্গলবার শহরের রাস্তায় প্রথমে আবেগময় সমাবেশ দেখা যায়। নিহতদের উদ্দেশ্যে শোক জ্ঞাপন এবং আহতদের দ্রুত সুষ্ঠ হয়ে ওঠার জন্য প্রার্থনা করতে দেখা যায় কয়েক হাজার মানুষকে। নাচের কর্মশালায় ছুরির হামলার ঘটনায় পুলিশ এক তরুণকে গ্রেফতার করে। অভিযুক্ত ল্যাঙ্কাশায়ারের ব্যাঙ্কসের বাসিন্দা অ্যাক্সেল মুগানওয়া রুদাকুবানার বিরুদ্ধে তিনজনের হত্যা, ১০ জনকে হত্যাচেষ্টা এবং ধারালো অস্ত্র (রান্নাঘরে ব্যবহৃত একটা বাঁকা ছুরি) রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের কার্ডিফে জন্ম এই ১৭ বছরের তরুণের। তার অভিভাবক রুয়ান্ডার বাসিন্দা। ২০১৩ সালে অভিভাবকের সঙ্গে সাউথপোর্ট এলাকায় চলে আসে অ্যাক্সেল মুগানওয়া রুদাকুবানার।
পুলিশ জানিয়েছে তার সঙ্গে ইসলামের কোনও যোগ নেই। কিন্তু ইন্টারনেট মাধ্যমে রটে যায়, ছুরির হামলায় অভিযুক্ত একজন শরণার্থী এবং মুসলিম। এই তথ্যকে কেন্দ্র করে ক্ষোভ জন্ম নেয়। মার্সিসাইড সমুদ্র তীরবর্তী শহরে এরপরই বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু হয়। ক্রমে এই বিশৃঙ্খলা সহিংসতার আকার নেয়। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রথম দফায় ৩৯ জন পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন, যাদের মধ্যে আটজনের অবস্থা গুরুতর। এর পাশাপাশি একটা মসজিদে হামলা ও জরুরি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেই থেকে দফায় দফায় যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে সহিংস অস্থির পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে।
অতি ডানপন্থী ইংলিশ ডিফেন্স লিগের সমর্থকরা এই সহিংসতার জন্য দায়ী বলে জানিয়েছে মার্সিসাইড পুলিশ। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কয়েকজন 'হলিডে ইন এক্সপ্রেস' নামে এক হোটেলে ঢোকার জন্য প্রথমে তার জানালা ভেঙে দেয়।