বাংলাদেশের আন্দোলনের স্লোগান এখন উত্তপ্ত করছে ভারতের রাজনীতির মাঠ! ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের স্লোগান ‘খেলা হবে’। পাশাপাশি ছিল ‘জয় বাংলা’। দু’টি স্লোগানেরই জন্মভূমি বাংলাদেশ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ যখন আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে, তখন দেখা যাচ্ছে সিপিএম-বিজেপি স্লোগান দিচ্ছে ‘দফা এক দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ।’ যে স্লোগান সামনে রেখে সম্প্রতি গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেছে বাংলাদেশে। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ থাকতে হচ্ছে শেখ হাসিনাকে।
কিন্তু এর পাশাপাশি যে আলোচনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে শুরু হয়েছে, তা হলো- সম্প্রতি বাংলাদেশের স্লোগানই মূলত দাপট দেখাচ্ছে এই বাংলার রাজনীতিতে? ওপারের স্লোগানে কি ‘ঝাঁজ’ বেশি? না কি নতুন স্লোগান তৈরিতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ঐতিহ্যে মরচে ধরেছে? রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদদের বিভিন্ন মত রয়েছে, ব্যাখ্যাও রয়েছে। কিন্তু একটি বিষয়ে সবাই একমত, কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের স্লোগানের ‘পশ্চিমবঙ্গীকরণ’ চলছে। আর তা জনপ্রিয়ও হচ্ছে।
বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনে রাজনৈতিক স্লোগানের ইতিহাস দীর্ঘ। স্বাধীনতার আগে থেকে তা চলে আসছে। বাংলা তথা বাঙালির দেওয়া স্লোগান জাতীয় স্তরের স্লোগানে রূপান্তরিত হয়। সেসব স্লোগান কালোত্তীর্ণ হয়ে থেকেছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাতেও সেই ধারা অব্যাহত থেকেছে বছরের পর বছর।
তেভাগা আন্দোলনের সময়ে ‘লাঙল যার, জমি তার’ স্লোগান কৃষক আন্দোলনে কার্যত অগ্নিবর্ষণ করে। ষাট বা সত্তরের দশকে বামেদের রাজনীতি ছিল মূলত জমিকেন্দ্রিক। সেই সময়েও ওই স্লোগান ফিরে এসেছে। জোতদার জমিদারদের হাত থেকে ‘বেনামি জমি’ দখল করে তা ভাগচাষিদের মধ্যে বিলিবণ্টন করার কর্মসূচিতে তেভাগার স্লোগান ব্যবহার করা হয়।
নকশালবাড়ি আন্দোলনে আবার চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন স্লোগানের বঙ্গীকরণ করা হয়েছে। ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ বা চীনা বিপ্লবের লাইন ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো’ স্লোগান হিসাবে ব্যবহার করা হয়। দেওয়ালে দেওয়ালে এ-ও লেখা হয়েছে, ‘চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান’।
রবীন্দ্রভারতীর সাবেক উপাচার্য তথা ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের বক্তব্য, বাংলাদেশের স্লোগান এপারে ব্যবহৃত হওয়াটা অন্যায় বলে মনে করি না। এটাকে ভাষাগত ঋণ বলা যেতে পারে। যা কিছু শুভ, তা আমরা গ্রহণ করতেই পারি। আবার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান প্রশান্ত রায়ের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে হয়তো নতুন স্লোগান তৈরির প্রয়োজনীয়তাই পড়ছে না। সে কারণেই নতুন স্লোগান তৈরি হচ্ছে না। তবে আরজি কর-কাণ্ডে যে নাগরিক আন্দোলন দেখছি, তাতে খুব যে রাজনৈতিক স্লোগানের দাপট রয়েছে, তেমন মনে হচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে ‘খেলা হবে’ স্লোগান প্রথম শোনা যায় বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের নেতা শামিম ওসমানের মুখে। কিন্তু তার এতটাই ব্যবহার পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে যে, পবিত্র জানতেন সেটি অনুব্রত মণ্ডলের তৈরি করা স্লোগান। আবার প্রেসিডেন্সির প্রশান্ত এতদিন জানতেন, মমতাই ওই স্লোগানের স্রষ্টা।
প্রবীণ তৃণমূল নেতা নির্বেদ রায়ের বক্তব্য, স্লোগান তৈরিতে যে মেধা লাগে, তার সামগ্রিক অবনমন ঘটেছে। সে কারণেই স্লোগান ‘ধার’ নিতে হচ্ছে। নির্বেদের কথায়, যে মধ্যবিত্ত অংশ স্লোগান তৈরি করত, নানা কারণে তার একটা অবনমন ঘটেছে। কৃষক বা শ্রমিকের জন্য স্লোগান কখনও সেই অংশ থেকে তৈরি হতো না। তৈরি হত মধ্যবিত্ত অংশ থেকেই। সেই জায়গায় একটা ফাঁক তৈরি হয়েছে।
সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সেলিম বাংলাদেশের স্লোগানকে এই পশ্চিমবঙ্গে ব্যবহার করার মধ্যে দোষ দেখছেন না। তার বক্তব্য, এপার বাংলাতেও নতুন স্লোগান তৈরি হচ্ছে। আবার ওপারের স্লোগানকেও নেওয়া হচ্ছে। সেলিমের কথায়, বাঙালি জাতিগত ভাবে অখণ্ড। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দু’পারেই সমান ভাবে রয়েছে। ফলে স্লোগান কাঁটাতার পেরিয়ে এলেও তার মধ্যে দোষের কিছু নেই। এই যে পদ্মাপারের স্লোগান বেশি বেশি করে গঙ্গাপারে অনুরণিত হচ্ছে, তার সবচেয়ে বড় কারণ সমাজমাধ্যম। পৃথিবী ছোট হয়ে গেছে। গান থেকে স্লোগান- সবই এখন এজমালি সম্পত্তি।