চীনে কর্মস্থলে বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে এবং শি জিনপিংয়ের শাসনের সময়, বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারীর পর এটি আরও বেড়েছে। এছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই) চালিত চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অ্যালগরিদমের ব্যবহারের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চীনে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসারের কারণে নারীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা তাদেরকে জনসংখ্যার সংকট মোকাবিলায় আরও সন্তান উৎপাদনের একটি হাতিয়ার বলে মনে করা হয়।
এআই নিয়োগের ক্ষেত্রে লিঙ্গ ও সাংস্কৃতিক পক্ষপাতকে বাড়িয়ে তুলবে বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদপত্র ইকোনমিক ডেইলি ‘অ্যালগরিদমিক পক্ষপাত ও বৈষম্য’ সম্পর্কে সতর্ক করেছে, কারণ বেইজিং তার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করছে। বিশেষ করে নতুন বিবাহিত এবং গর্ভবতী চীনে
লন্ডন ভিত্তিক চ্যাথাম হাউসের গবেষক নিকি সান বলেছেন, চীনে এআই অন্তর্ভুক্তিকরণ কর্মীদের কল্যাণের চেয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থকে বেশি সমর্থন করে, যা কর্মীদের শোষণের দিকে নিয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, চীনে যেখানে লিঙ্গ এবং বয়স সম্পর্কে পক্ষপাত দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত, সেখানে এআই প্রায়ই এই বিদ্যমান পক্ষপাতগুলোকে না মিটিয়ে আরও বাড়িয়ে তুলছে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক চাকরির ক্ষেত্রে বয়সের পরিসীমা এবং লিঙ্গ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় এবং নারীদের প্রায়শই তাদের বৈবাহিক অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়।
এআই এর উদ্ভাবনী প্রযুক্তির গ্রহণের লক্ষ্য ছিল লিঙ্গ ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য দূর করা। কিন্তু চীনে এটি বিপরীত দিকে কাজ করছে। বেইজিংয়ের পরিচালিত সার্চ ইঞ্জিনগুলিতে ‘সিইও’ বা ‘প্রকৌশলী’ বা ‘বিজ্ঞানী’ শব্দ টাইপ করলে পুরুষদের ছবি প্রদর্শন করে। অন্যদিকে, অন্যদিকে, ‘ওমেন’ বা ‘ফেমিনিন’ শব্দের প্রতিক্রিয়াগুলি যৌন প্রকৃতি বা মহিলা লিঙ্গের উপাদান দিয়ে চিত্রিত করা হয়।
একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে ৮০ শতাংশ নারীর চাকরি এআই দ্বারা খারাপভাবে প্রভাবিত হবে। নিকি সান বলেন, চীনের এআই ভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থাগুলি প্রায়ই বৈষম্যমূলক ফিল্টার ব্যবহার করে, যেখানে ব্যক্তিগত তথ্য – যা চাকরির জন্য প্রাসঙ্গিক নয় – তা মূল্যায়ন করা হয়। তিনি আরও বলেন, চীনে অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগকারীদের পছন্দের এআই মডেল তৈরি করে বৈষম্য ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা হয়, যা ক্ষতিগুলি বাড়িয়ে দিতে পারে।
বেইজিং ভিত্তিক গবেষকদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা পুরুষদের তুলনায় এআই দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নারীরা চাকরির সন্ধান, উন্নতির সুযোগ এবং শ্রমের জন্য ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় অধিক বৈষম্যের শিকার হন। যদি এআই এর প্রভাব অনিবার্য হয়, তবে নারীদের বিরুদ্ধে বৈষম্য কমানো অপরিহার্য যাতে শ্রম বাজারে লিঙ্গের ব্যবধান আরও না বাড়ে। লিঙ্গ বৈষম্য, গৃহস্থালি সহিংসতা এবং শিশু হত্যা চীনের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে গভীরভাবে রূপ নেওয়া এক একটি সমস্যা।
ডারহাম ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক জিয়ান্নান লু বলেন, অর্থনৈতিক চাপ এবং দীর্ঘস্থায়ী পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির পারস্পরিক সম্পর্ক লিঙ্গ বিষয়ক একটি দৃঢ় রক্ষণশীল অবস্থান গড়ে তুলেছে। চীনের বিরোধী নারীবাদীরা প্রায়ই 'ঐতিহ্যগত নৈতিকতার' ওপর ভিত্তি করে বিয়ের পক্ষে কথা বলে এবং নারীবাদী প্রচারণার বিরোধিতা করে।
চীনা নারীবাদী কর্মী লিউ পিন বলেন, যদিও বেইজিং সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে চাকরি প্রত্যাশী প্রার্থীদের বৈবাহিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার বিষয়ে নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ বা শাস্তির অভাবের কারণে অনেক কোম্পানি তা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, নারীদের অগ্রগতিতে বাধা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানগত অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেমন, নিয়োগে লিঙ্গ বৈষম্য স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে গৃহীত হয়।
লু বলেন, বেইজিং সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে লিঙ্গ সমতার সমর্থন করে এবং সংশ্লিষ্ট নীতিগুলি তৈরি করে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। শি জিনপিং নারীদের কাজ ছেড়ে বেশি সন্তান উৎপাদনের জন্য আবেদন করেছিলেন, যা মাও যুগের প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে দেখা হয়। এটি লিঙ্গ সমতার বিরুদ্ধে অনুভূতিকে বাড়িয়ে তুলেছে।
আইটি বিশেষজ্ঞ কুয়াং কুন বলেন, চীনের প্রোগ্রামারদের প্রায় ৯০ শতাংশ পুরুষ এবং অ্যালগরিদম ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে লিঙ্গ সমতার সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, অ্যালগরিদমে লিঙ্গ বৈষম্য রয়েছে কারণ এআইকে প্রশিক্ষণের জন্য সংগৃহীত তথ্য মানব জগতে বিদ্যমান বৈষম্যকে প্রতিফলিত করে এবং অ্যালগরিদম ইঞ্জিনিয়াররা সচেতনতা না থাকার কারণে এর সমাধান অন্তর্ভুক্ত করেন না।
সূত্র: ইউরোপিয়ান টাইমস