ঢাকা | বঙ্গাব্দ

ট্রাম্পকে কেন দ্বিতীয়বার সুযোগ দিল মার্কিনীরা?

ট্রাম্পকে ভোট দেওয়া বহু মানুষ বলেছেন, তারা মনে করেন ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তারা বর্তমানের চেয়ে ভালো ছিলেন।
  • | ০৭ নভেম্বর, ২০২৪
ট্রাম্পকে কেন দ্বিতীয়বার সুযোগ দিল মার্কিনীরা? ডোনাল্ড ট্রাম্প

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ১২০ বছর পর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাল ডোনাল্ড ট্রাম্প। দেশটির ২২তম এবং ২৪তম প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের রেকর্ডে ভাগ বসালেন তিনি। দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে এক মেয়াদের বিরতিতে দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম এবং ৪৭তম প্রেসিডেন্ট তিনি। নাটকীয় এক প্রত্যাবর্তনে হোয়াইট হাউজ ছাড়ার চার বছর পর আবারও মসনদে বসতে যাচ্ছেন ট্রাম্প।


২০২০ সালের নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে হারলেও নির্বাচনের ফল মেনে নিতে অস্বীকার করেন ট্রাম্প। নির্বাচনে হারার পরও প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকার জন্য সেবার তিনি যে পদক্ষেপ নেন, সেসব কার্যক্রমের সমালোচনা এখনও মানুষের মুখে মুখে। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলের সহিংস হামলার দায়ে তার বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। পাশাপাশি ব্যবসায়িক নথি জাল করার দায়ে গত বছর অভিযুক্ত হওয়ায় তিনি প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়ে ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন যাকে আদালত অপরাধী হিসেবে রায় দিয়েছে। কাজেই ট্রাম্পকে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসবে নির্বাচিত করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।


ট্রাম্পের এবারের নির্বাচনী প্রচারণার সময়ও বেশ নাটকীয় ঘটনা দেখা যায়। প্রচারণার সময় ট্রাম্পকে দুই দফা হত্যাচেষ্টা, তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন নির্বাচনের কয়েক মাস আগে নাম সরিয়ে নেওয়া ইত্যাদি। প্রচারণার পুরোটা সময় ট্রাম্প বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেছেন, তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হেয় করে কৌতুক করেছেন ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেই অঙ্গরাজ্যগুলোতে হয়েছে, সেসব অঙ্গরাজ্যে মার্কিনীরা ভোট দিয়েছেন ট্রাম্পকে। ভোটারদের অনেকেই ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার পেছনে অর্থনীতি ও অভিবাসনের মত ইস্যুগুলোকে সামনে রাখছেন।


যেভাবে অর্থনীতি নিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্য সাড়া ফেলেছে


নির্বাচনী প্রচারণার সময় অধিকাংশই বলেছেন, তারা সুযোগ পেলে ট্রাম্পের ‘দুর্গন্ধযুক্ত কথাবার্তা’ বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার পক্ষপাতী। এর কারণ হিসেবে তারা ট্রাম্পের একটি প্রশ্নের ওপর জোর দিচ্ছেন যেটি তিনি সব র‍্যালিতে জিজ্ঞেস করেছেন। ট্রাম্প প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা কি দুই বছর আগের তুলনায় এখন ভালো আছেন?’ ট্রাম্পকে ভোট দেওয়া বহু মানুষ বলেছেন, তারা মনে করেন ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তারা বর্তমানের চেয়ে ভালো ছিলেন।


অর্থনৈতিক মন্দা বা মূল্যস্ফীতির মত অর্থনৈতিক সংকটের জন্য বাইডেন প্রশাসন দায়ী বলে মনে করেন ভোটারদের একটা বড় অংশ। বাইডেন প্রশাসনের অধীনে রেকর্ড মাত্রার অবৈধ অভিবাসন নিয়েও ভোটারদের একটা বড় অংশকে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করতে দেখা যায়। ট্রাম্প বা তার সমর্থকদের মতো এই ভোটারদের অনেকেই সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের পক্ষপাতী।


‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান


২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। পুরো যুক্তরাষ্ট্রে ডানপন্থী ও বামপন্থীদের মধ্যে যে হতাশা দেখা গেছে তা হলো— তারা মনে করেন ইউক্রেনে যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে তা যদি যুক্তরাষ্ট্রে খরচ করা হতো তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে অনেক শক্তিশালী করতে পারত। এই বিষয়টি মাথায় রেখে অনেকেই চার বছর জো বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কমালা হ্যারিসকে ভোট দেননি। তারা মনে করেছেন, কমলা হ্যারিসকে ভোট দিলে ইউক্রেন বিষয়ক নীতি অনেকটা একরকমই থাকত।


তবে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে মার্কিন নীতির কতটা পরিবর্তন হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের মধ্যে। ২০১৬ সালে তিনি যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন তখন রাজনৈতিকভাবে অনেকটা বহিরাগতই ছিলেন। সেসময় শুরুতে একটা সময় পর্যন্ত তিনি অভিজ্ঞ রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের পরামর্শ নিয়েছেন। তবে এই দফায় তিনি খুব একটা নিয়মমাফিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চান বলে মনে হয় না। ওই উপদেষ্টাদের অনেকেই পরবর্তীতে ট্রাম্পকে ‘মিথ্যাবাদী’, ‘ফ্যাসিস্ট’, ‘অনুপযুক্ত’ বলে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তাদের মতে, এ দফায় ট্রাম্প যদি তার অনুগতদের পাশে রেখে শাসনকাজ পরিচালনা করেন, তাহলে খুব শিগগিরই তিনি তার চরমপন্থি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করে দেবেন।


এবারের নির্বাচনে ভোটারদের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের দুইটি দিক তুলে ধরা হয়। ভোটারদের ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, তাদের দেশ ক্রমাগত ধ্বংসের পথে যাচ্ছে এবং শুধুমাত্র তিনি দেশকে ‘আবারও মহান দেশে পরিণত’ করতে পারবেন। অন্যদিকে, কমলা হ্যারিস সতর্ক করেছেন যে যদি ট্রাম্প নির্বাচিত হন তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রই অস্তিত্বের সংকটে পড়বে।


ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনের মত কর্তৃত্ববাদী নেতাদের প্রশংসা করেছেন। তার বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘তারা তাদের ক্ষেত্রের শীর্ষে রয়েছেন, আপনার ভালো লাগুক আর না লাগুক।’


গণমাধ্যমে তার সমালোচনা বন্ধ করার বিষয়েও কথা বলেছেন তিনি। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে তিনি এমন মন্তব্যও করেছেন যে গণমাধ্যমের কর্মীরা মারা গেলেও তিনি খুব একটা ব্যথিত হবেন না। তবে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এখন মানুষ হয়তো বাস্তবিক জানতে পারবে যে এতদিন প্রচারণার সময় তিনি যা যা বলেছেন, তার কতটুকু বলার জন্য বলা আর কতটুকু আসলেই তিনি বাস্তবায়ন করতে চান। প্রথম দফা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ পাননি। এবার দ্বিতীয় দফায় তার প্রস্তাবিত অনেক পরিকল্পনাই হয়তো বাস্তবে রূপ দিতে চাইবেন তিনি।


শুধু যে মার্কিনিরাই ট্রাম্পকে দ্বিতীয় দফায় মোকাবিলা করতে যাচ্ছে, তা নয়। সারাবিশ্বও দেখতে পাবে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বলতে তিনি আসলে কী বোঝান। সেইসঙ্গে এখন দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব, ইউক্রেন আর মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধ করার দাবিসহ ট্রাম্পের দাবি করা বিভিন্ন নীতি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।