ঢাকা | বঙ্গাব্দ

‘বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছিল স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক’

ভারত যদি তাকে প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকার করে, ‘বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণভাবে ভারতবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি দেখতে পাব।’
  • অনলাইন ডেস্ক | ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪
‘বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছিল স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক’ শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি

প্রায় দেড় দশক, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক উপভোগ করেছে। কিন্তু এ বছরের মাঝামাঝিতেই সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। সিভিল সার্ভিসের চাকরির কোটার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ ছাত্র বিক্ষোভ একসময় পরিণত হয়   বাংলাদেশের স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার দেশব্যাপী আন্দোলনে।


কাগজে কলমে ‘বিশ্বের প্রথম জেন জি বিপ্লব’ হিসাবে বর্ণিত সেই বিক্ষোভে তিনি অবশেষে দিল্লিতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। বাংলাদেশে একজন হিন্দু নেতাকে গ্রেপ্তার এবং ভারতের একটি কনস্যুলেটে জনতার হামলা দুই দেশের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এখন দক্ষিণ এশীয় এই দুিই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খুবই কম এবং ধর্মীয় উত্তেজনা বেশি দেখা যাচ্ছে।


‘আয়রন লেডি’ শেখ হাসিনার কট্টর শাসনের অধীনে, ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে তার অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের তুলনায় একটি স্থিতিশীল অংশীদার বলে মনে করে আসছে। কিন্তু হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামল আগস্টে আকস্মিকভাবে শেষ হওয়ার পর, বাংলাদেশে বর্তমানে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার রয়েছে যাকে হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করতেন এবং তাকে অপদস্থ করার নানাবিধ কার্যক্রম বিভিন্ন সময়ে গ্রহন করা হয়েছে।


হিন্দুরা বাংলাদেশের সাড়ে ১৭ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ এবং তাদের একটি অংশ অন্ধভাবে হাসিনার আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে আসছে। হাসিনা ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়ে গেলে, দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের প্রতীক, বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত দলটির নেতাকর্মীদের টার্গেট করে। এদের কয়েকজন হিন্দু হওয়ায় সেই সুযোগটি নেয় ভারত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ডেপুটি এশিয়া ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলী আগস্টে জানান, বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ‘আক্রমণ করা হয়েছে, তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, মন্দির ভাংচুর করা হয়েছে এবং দোকান লুট করা হয়েছে’।


ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সরকার বিষয়টি নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিলেও ভারত অভিযোগ করেছে ইউনূসের সরকার হিন্দুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট কাজ করেনি। ভারতে নির্বাসিত থেকে, হাসিনা দাবি করেছেন ইউনূস সংখ্যালঘুদের ‘গণহত্যার’ জন্য দায়ী।


ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-গাজার মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব এবং বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উল্লেখ করে ‘অপ্রত্যাশিত’ কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে এবং প্রতিবেশী দেশগুলির পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার আহ্বান জানান। কিন্তু নভেম্বরের শেষের দিকে বাংলাদেশে একজন হিন্দু ধর্মীয় নেতাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে একটি বড় কূটনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।


অক্টোবরে এক সমাবেশে বাংলাদেশের পতাকাকে অবমাননার অভিযোগে হিন্দু নেতা কৃষ্ণ দাস প্রভুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভারত থেকে দাবি করা হয়, হিন্দুদের বিরুদ্ধে হামলা নিয়ে সোচ্চার হওয়ায় তাকে ‘হয়রানি’ করা হচ্ছে। ভারতে কট্টরপন্থী হিন্দু গোষ্ঠীগুলি চলমান বিক্ষোভ করছে। ফলে বাংলাদেশেও এর বিপরীতটি দেখা যাচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসিনা সরকারের পতনের অনেক আগে থেকেই এই অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে।


সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ফেলো অমিত রঞ্জন বলেন, ‘বাংলাদেশে সবসময়ই এই অনুভূতি থাকে যে ভারত বাংলাদেশের বিষয়ে খুব বেশি হস্তক্ষেপ করে। তারা আরও মনে করে ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তার হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন পাকাপোক্ত হয়েছে’।


বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির গবেষক খন্দকার তাহমিদ রেজওয়ান বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শুধুমাত্র ‘হাসিনা ও তার আওয়ামী শাসনাগোষ্ঠীর সঙ্গে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে নয়। আমরা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বলে উপহাস করতাম।’


ড. ইউনূস বলেছেন বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন ২০২৫ সালের শেষ দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত হবে। ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), পরবর্তী নির্বাচনে পূর্ণ বিজয় অর্জন করতে পারে। ভারতের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা জেনসের সিনিয়র বিশ্লেষক শিবানী গায়কওয়াদ বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন গঠনের পর থেকে বিএনপি তার চীনপন্থী অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। শিবানি বলেছেন, ‘চীনপন্থী অবস্থান নিয়ে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা খুব বেশি সেক্ষেত্রে এটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।’ 


আরও গুরুত্বপূর্ণ, অক্টোবরে বাংলাদেশের একটি ট্রাইব্যুনাল অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য হাসিনার গ্রেপ্তারের পরোয়ানা জারি করেছে। বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরিতে তাহমিদ রেজওয়ানের মতে ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি এবং বিরোধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস উভয়েই হাসিনার প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে একজোট হবে।


তবু দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যত নির্ভর করছে ভারত সরকার তাকে হস্তান্তর করতে প্রস্তুত কিনা তার উপর। অস্ট্রেলিয়ায় সাত বছর নির্বাসনের পর, বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার কর্মী মোবাশ্বর হাসান হাসিনার পতনের পর তার জন্মের দেশে ফিরে আসেন। ড. হাসান এবিসির দ্য ওয়ার্ল্ডকে বলেছেন, ভারত যদি তাকে প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকার করে, ‘বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণভাবে ভারতবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি দেখতে পাব। ভারতও চাইবে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে পুনর্বাসন করুক, পুনর্গঠিত হোক এবং মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসুক।’


এসজেড