অবশেষে সিলমোহর পড়েই গেল ইয়েমেনের কারাগারে মুক্তির আলোর অপেক্ষায় থাকা আলোচিত ভারতীয় নার্স নিমিশা প্রিয়ার (৩৬) মৃত্যুদণ্ডের রায়ে। সোমবার (৩০ জানুয়ারি) নিমিশার মৃত্যুদণ্ডের রায় অনুমোদন করেছেন ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট রাশাদ আল-আলিমি। সাত বছর ইয়েমেনের জেলে বন্দি অভিবাসী কেরালার তরুণীর জীবনসংশয় হয়ে যাওয়ায় বিচলিত তার মা, তার পুরো পরিবার। আগামী এক মাসের মধ্যে নিমিশার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন আদালত। ইয়েমেনের সরকারি গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি এই খবর জানিয়েছে।
ইয়েমেনি নাগরিক তালাল আব্দো মাহদিকে হত্যার দায়ে ২০১৭ সাল থেকে কারাগারে বন্দি নিমিশা। এই সাত বছরে তার পরিবার থেকে ৩৬ বছর বয়সি নিমিশাকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি। ২০১৮ সালে ইয়েমেনের আদালত তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। এ বার সেই রায়েই প্রেসিডেন্টের সিলমোহর পড়েছে। ‘অস্বাভাবিক’ কিছু না ঘটলে আগামী এক মাসের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে বলে।
ভারতের কেরালা রাজ্যের পালাক্কড জেলার বাসিন্দা নিমিশা পেশায় একজন নার্স। তার স্বামী টমি থমাস এবং একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ইয়েমেনে বসবাস করতেন তিনি। নিমিশা ২০০৮ সাল থেকে ইয়েমেনের একটি বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করতেন। ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ২০১৪ সালে তার স্বামী ও ১১ বছর বয়সী একমাত্র কন্যা ভারতে ফিরে গেলেও প্রিয়া সেখানেই থেকে যান। কিন্তু তার স্বামী ও কন্যা আর ইয়েমেনে ফিরতে পারেননি। কারণ যুদ্ধের জন্য তাদের আর ভিসা দেয়নি ইয়েমেন সরকার।
নিমিশার স্বপ্ন ছিল নিজের ক্লিনিক চালু করার। সেই বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালেই তালাল আব্দো মাহাদি নামের এক ইয়েমেনি নাগরিকের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। মাহাদি তাকে ক্লিনিক খোলার ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। কারণ, সেই দেশের আইন অনুযায়ী যে কোনো ধরনের ব্যবসা শুরু করতে গেলে দেশীয় অংশীদারের প্রয়োজন। পরিকল্পনা মতো ২০১৫ সালে দু’জন মিলে নতুন ক্লিনিক চালু করেন।
এর পর থেকেই শুরু হয় দুই অংশীদারের মতবিরোধ। প্রথমেই নিমিশার টাকাপয়সা কেড়ে নেন ওই যুবক। বিরোধ বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে তার পাসপোর্টও কেড়ে নেন মাহদি, যাতে কোনও ভাবেই নিমিশা ইয়েমেন ছাড়তে না-পারেন। মাহদি তাকে মাদকসেবনেও বাধ্য করেন। আইনি কাগজপত্রে নিমিশাকে নিজের স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিয়েছিলেন মাহদি, ফলে নিমিশার প্রশাসনিক সাহায্য পাওয়া জটিল হয়ে পড়ে। একাধিক বার পুলিশের দ্বারস্থ হলেও লাভ হয়নি। মাসখানেক জেলে থাকার পরেই ছাড়া পেয়ে যান মাহদি। জেল থেকে বেরিয়ে নিমিশার জীবন আরও দুর্বিষহ করে তোলেন তিনি।
বাধ্য হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই মাহদিকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেন ওই নার্স। নিমিশার দাবি, মাহদিকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের পাসপোর্ট পুনরুদ্ধার করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। কিন্তু ওভারডোজ়ের কারণে মৃত্যু হয় মাহদির। এর পর হানান নামে এক সহকর্মীর সঙ্গে মিলে মাহদির দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে পানির ট্যাঙ্কে ফেলে দেন ওই নার্স। ওই মাসেই ইয়েমেন ছেড়ে পালানোর সময় ধরা পড়ে যান নিমিশা। সেই থেকে ইয়েমেনের জেলেই বন্দি রয়েছেন ভারতের যুবতী।
মাহদিকে হত্যার দায়ে ২০১৮ সালে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ইয়েমেনের আদালত। মৃত্যুদণ্ড পান নিমিশা। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন নিমিশা। আদালতে তিনি বক্তব্যে বলেন, মাহাদি তার ওপর অমানবিক অত্যাচার চালাতেন। তার পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আত্মরক্ষার্থে মাহাদিকে হত্যা করেন তিনি। কিন্তু ইয়েমেনের সুপ্রিম কোর্ট তার আবেদন খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। এই সাত বছরে পরিবার থেকে ৩৬ বছর বয়সি নিমিশাকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টা করা হয়েছে। আইনজীবীর ব্যবস্থা করে দেয় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মেয়েকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টা করেন নিমিশার মা প্রেমা কুমারী। এই পরিস্থিতিতে নিমিশার প্রাণ বাঁচানোর একমাত্র উপায় ‘ব্লাড মানি’। ইয়েমেনের আইন অনুযায়ী, হত্যার শিকার ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা অর্থের বা ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে হত্যাকারীকে প্রাণ ভিক্ষা দিতে পারেন। এখন সেই চেষ্টাই শুরু করেছে নিমিশার পরিবার। সেই শেষ চেষ্টা হিসাবে ‘দিয়া’ (নিহতের পরিবারের নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের অঙ্ক) দিয়ে মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন নিমিশার মা। সে জন্য চলতি বছরেই জমিবাড়ি বেচে ইয়েমেনে চলে এসেছেন প্রৌঢ়া।
আসল সমস্যা হলো ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুর হওয়ার পর থেকে ভারত সেই দেশ থেকে কূটনৈতিক মিশন প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে দেশটিতে বর্তমানে ভারতের কোনো প্রতিনিধি নেই। এমনকি ভারতীয়দের ইয়েমেনে যেতেও দেওয়া হয় না। মেয়ের জীবন বাঁচাতে নিমিশার মা ইয়েমেনে যাওয়ার জন্য ভারতের আদালতের দ্বারস্থ হন। আদালত প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন তাকে ইয়েমেন পাঠানোর ব্যবস্থা করার জন্য।
সহযোগিতার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে নিমিশার পরিবারকে প্রায় ২০ হাজার ডলার দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ঐ টাকা দিয়ে নিমিশার জন্য আইনজীবী ঠিক করা হয়েছে। সেই আইনজীবী আরো ২০ হাজার ডলার চেয়েছেন মাহাদির পরিবারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার জন্য। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রনধীর জয়সওয়াল জানিয়েছেন, নিমিশা ও তার পরিবারকে সব রকমের সহযোগিতা করা হবে। প্রয়োজনে ভারত সরকার ইয়েমেন সরকারের সঙ্গেও কথা বলবে। জয়সওয়াল আরো বলেছেন, ‘গোটা পরিস্থিতি নিয়ে ভারত সরকার ওয়াকিবহাল। নিমিশার পরিবারও সব রকম চেষ্টা করেছে। সরকার যথাসাধ্য সাহায্য করছে।’
সূত্র: এএফপি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি
এসজেড