বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন চরম সংকটে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, মিডিয়া ট্রায়াল এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত অনিয়মের কারণে দেশের ১০টি ব্যাংক গভীর সমস্যার মুখে পড়েছে। এই ব্যাংকগুলোসহ পুরো ব্যাংকিং খাতে ৭৬০ জন পরিচালক প্রায় ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন, যা অধিকাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর অস্তিত্ব রক্ষা করতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ধার দেওয়া হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
ব্যাংক খাতের এই সংকটের নেপথ্যে রয়েছে বেনামি ঋণ প্রদান, পরিবারের প্রভাব খাটিয়ে ঋণ মঞ্জুর, ঋণের টাকা বিদেশে পাচার, রাজনৈতিক মদদে ঋণ অনুমোদন এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি। এসব কারণে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে সবল ব্যাংক থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সাময়িকভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হলেও এটি স্থায়ী সমাধান নয়।
খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে দেশের শীর্ষ ১০টি শিল্পগোষ্ঠীকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই চাপ সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ইতোমধ্যেই বেক্সিমকো গ্রুপে রিসিভার বসানোর ফলে ১৮টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, এবং প্রায় ৫০ হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। অন্যান্য গ্রুপের ক্ষেত্রে একই ধাঁচের পদক্ষেপ নেওয়া হলে দেশের শিল্প খাত আরও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, শিল্প-কারখানা বন্ধ না করে এবং শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বজায় রেখেই ঋণ আদায়ের কৌশল নিতে হবে। হঠাৎ চাপ প্রয়োগ করলে গ্রুপগুলো আরও দুর্বল হবে, যার প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে।
এদিকে, কিছু গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার চালানোর অভিযোগ উঠেছে। এসব প্রচার গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে ব্যাংকগুলো আরও তারল্য সংকটে পড়েছে।
ব্যাংকিং খাতের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। গত কয়েক মাসে ব্যাংকগুলোর জন্য সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে সরবরাহ করা হয়েছে এবং ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে এ সহায়তা ব্যাংকগুলোর সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারছে না।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংক খাতের এই সংকট শুধু পরিচালনা পর্ষদের অনিয়মের ফল নয়, বরং শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ এবং দুর্নীতিও দায়ী। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণের কোনো সহজ পথ নেই।
দেশের ব্যাংকিং খাতের এই সংকটের সমাধান না হলে তা ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জাতীয় অর্থনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
thebgbd.com/NIT