পাঁচ দশক আগে লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের যে জায়গাটি কিশোর অঞ্জনা রহমানকে বানিয়েছিলেন নায়িকা, সেই এফডিসিতে কফিনবন্দি হয়ে শেষবারের মত এলেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের এই অভিনেত্রী।
শনিবার (৪ জানুয়ারি) বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে অঞ্জনার মরদেহ বহনকারী গাড়িটি এফডিসিতে পৌঁছালে শোকাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শেষবারের মতো এই চিত্রনায়িকাকে দেখতে আসেন দীর্ঘদিনের সহকর্মী, ভক্ত থেকে সংবাদকর্মীরা। জোহরের নামাজের পর প্রথম জানাজা শেষে মরদেহ নেওয়া হয় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
অঞ্জনাকে শেষবিদায় জানাতে এদিন এফডিসিতে এসেছিলেন চিত্রনায়ক আলমগীর, উজ্জল, ইলিয়াস কাঞ্চন, চিত্রনায়িকা নূতন, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর, চিত্রনায়ক মেহেদী, অভিনেতা সুব্রত, নাসরিন, চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস, জয় চৌধুরী, রোমানা মুক্তিসহ অনেকে। পরিচালকদের মধ্যে ছটকু আহমেদ, শাহিন সুমন, মুশফিকুর রহমান গুলজার, চয়নিকা চৌধুরী, প্রযোজকনেতা খোরশেদ আলম খসরুসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
এসেছিলেন প্রযোজক সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক, চিত্রগ্রাহক সমিতির সদস্যসহ চলচ্চিত্রের বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা।
অঞ্জনার স্মৃতিচারণা করে চিত্রনায়িকা নূতন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘একই সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের পথচলা। আমরা দুজন বোনের মতো ছিলাম। যেখানেই যেতাম, আমরা এত হাসিঠাট্টা করতাম, সবাই ভাবত আমরা আপন দুই বোন। ডিসেম্বরের ৬ তারিখে সবশেষ দেখা হয়েছিল। আর দেখা হবে না ভাবতেই শূন্যতা অনুভব করছি।’
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অঞ্জনা আপার এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। একজন ভালো শিল্পীর বাইরে অসম্ভব ভালো একজন মানুষ ছিলেন তিনি। তার প্রাণবন্ত ও হাসিমাখা মুখ মিস করব। সবাই তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করবেন।’
চিত্রনায়ক উজ্জল বলেন, ‘চলচ্চিত্রে নায়িকা হওয়ার আগে তিনি এ দেশের একজন খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী ছিলেন। আমি দেখেছি, সে সময় বিদেশি রাষ্ট্রীয় অতিথি থেকে সরকারি বড় বড় অনুষ্ঠানে তার নাচের ডাক পড়ত। সবাই তার নাচের প্রশংসা করত। পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্রে এসেও অনেক কালজয়ী সিনেমায় তিনি তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। এভাবে আমরা সবাই একদিন চলে যাব, আমাদের কাজই থেকে যাবে। যারা চলে গেছেন, তাদের স্মৃতি যেন আমরা সব সময় স্মরণ করি।’
তবে উপস্থিত থাকলেও গণমাধ্যমকে কথা বলতে রাজি হননি চিত্রনায়ক আলমগীর ও ইলিয়াস কাঞ্চন। কথা বলার মতো মানসিক অবস্থায় নেই বলে জানান দুই অভিনেতা।
গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাত ১টা ১০ মিনিটে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী অঞ্জনা রহমান। জানা গেছে, তিন সপ্তাহ ধরে অসুস্থ ছিলেন একসময়ের জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী। শুরুতে জ্বর ছিল। সারা শরীর কেঁপে জ্বর আসত। একটা সময় ওষুধ খেয়েও কাজ হচ্ছিল না। শেষে জানা যায়, তার রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এরপর অঞ্জনাকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে কয় দিন তাকে রাখা হয় সিসিইউতে।
সেখানকার চিকিৎসায় শারীরিক অবস্থার আশানুরূপ উন্নতি না হওয়ায় হাসপাতাল বদলে গত বুধবার অঞ্জনাকে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ওই রাতেই তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। ভেন্টিলেশনে থাকা অবস্থায় তার অবস্থার কখনো উন্নতি, কখনো অবনতি হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত চলেই গেলেন এই নায়িকা।
সিনেমায় আসার আগেই অঞ্জনা পরিচিতি পান নৃত্যশিল্পী হিসেবে। ১৯৭৬ সালে বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘সেতু’ চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি ঢাকাই সিনেমায় কাজ শুরু করলেও তার মুক্তি পাওয়া প্রথম চলচ্চিত্র ছিল শামসুদ্দিন টগর পরিচালিত ‘দস্যু বনহুর’। নায়ক সোহেল রানার বিপরীতে ওই সিনেমার পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি অঞ্জনাকে।
নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে তাকে দেখা গেছে ৩০টি সিনেমায়, যার মধ্যে রয়েছে ‘অশিক্ষিত’, ‘রজনীগন্ধা’, ‘আশার আলো’, ‘জিঞ্জির’, ‘আনারকলি’, ‘বিধাতা’, ‘বৌরানী’, ‘সোনার হরিণ’, ‘মানা’, ‘রামরহিমজন’, ‘সানাই’, ‘সোহাগ’, ‘মাটির পুতুল’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ও ‘অভিযান’এর মত দর্শকনন্দিত চলচ্চিত্র।
এছাড়া ভারতের সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তী, পাকিস্তানের অভিনেতা ফয়সাল, নাদীম, জাভেদ শেখ, ইসমাইল শাহ, নেপালের শীবশ্রেষ্ঠ ও ভুবন কেসির সঙ্গেও অভিনয় করেছেন এই নায়িকা।
চার দশকের ক্যারিয়ারে শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন অঞ্জনা। ‘গাংচিল’ সিনেমার জন্য ১৯৮২ সালে এবং ‘পরিণীতা’ সিনেমার জন্য ১৯৮৬ সালে পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। পাশাপাশি তিনবার বাচসাস এবং নৃত্যে দুবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৯৯২ সালের পর থেকে সিনেমায় অনিয়মিত হয়ে যান অঞ্জনা। ২০০৮ সালে মুক্তি পায় তার সর্বশেষ সিনেমা ‘ভুল’।
অভিনয়ে অনিয়মিত হয়ে গেলেও তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘অঞ্জনা ফিল্মস’ থেকে ‘প্রাণ সজনি’, ‘বন্ধু যখন শত্রু’, ‘চালু সরদার’সহ অনেকগুলো সিনেমা মুক্তি পায়।
পর্দায় সক্রিয় না হলেও চলচ্চিত্র অঙ্গনে নিয়মিতই যাতায়াত ছিল তার। সর্বশেষ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
thebgbd.com/NA