ঢাকা | বঙ্গাব্দ

এমপিওভুক্তদের অবসর কল্যাণ সুবিধা অনিশ্চয়তায়

বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ সুবিধার অনিশ্চয়তা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
  • নিজস্ব প্রতিবেদক | ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
এমপিওভুক্তদের অবসর কল্যাণ সুবিধা অনিশ্চয়তায় ফাইল ছবি

বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ সুবিধার অনিশ্চয়তা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। অর্থ সংকট আগে থেকেই ছিল, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এই দুরবস্থা আরও প্রকট হয়েছে। পাশাপাশি, প্রায় ছয় মাস ধরে অবসর ও কল্যাণ সুবিধা বোর্ড কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ফলস্বরূপ, শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাপ্য অর্থ পেতে অপেক্ষার সময়সীমা আরও বেড়েছে। বর্তমানে ৭৪ হাজারের বেশি শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদন নিষ্পত্তিহীন অবস্থায় আটকে আছে।


অবসরের পরপরই প্রাপ্য সুবিধাগুলো পাওয়ার প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবে এখন শিক্ষক-কর্মচারীদের তিন থেকে চার বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। গত ছয় মাসে বোর্ডের কোনো বৈঠক না হওয়া এবং সচিব নিয়োগ না থাকার ফলে নতুন করে অর্থ ছাড়ের অনুমোদন মিলছে না। এই দীর্ঘসূত্রিতার ফলে শিক্ষক-কর্মচারীদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।


অবসর ও কল্যাণ সুবিধা বোর্ডের কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, এই দুর্দশার সমাধানে তাদের হাতেও বিশেষ কিছু করার সুযোগ নেই। তারা আশা করছেন, সরকার দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করবে।


সারা দেশে পাঁচ লাখের বেশি বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। তাদের অবসর ও কল্যাণ সুবিধার অর্থদানের দায়িত্ব পালন করে দুটি পৃথক প্রতিষ্ঠান—বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট এবং অবসর সুবিধা বোর্ড। রাজধানীর পলাশী-নীলক্ষেত এলাকায় বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ভবনে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। সেখানে গেলে দেখা যায়, অনেক শিক্ষক-কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা অবসর ও কল্যাণ সুবিধার অর্থ পাওয়ার আশায় এসেছেন, কিন্তু আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, তার বাবা গাইবান্ধার একটি কলেজের শিক্ষক ছিলেন এবং ২০২০ সালে অবসর গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এতদিন পরও তিনি অবসর সুবিধার অর্থ পাননি।


অবসর ও কল্যাণ সুবিধা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, অবসর সুবিধার জন্য ৩৮ হাজার এবং কল্যাণ সুবিধার জন্য ৩৬ হাজার আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। বিদ্যালয় পর্যায়ের আবেদনগুলোর মধ্যে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত অনুমোদন হয়েছে, কলেজ পর্যায়ে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এবং মাদ্রাসা পর্যায়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। কল্যাণ ট্রাস্টের ক্ষেত্রেও ২০২২ সালের মে পর্যন্ত আবেদনগুলোর অনুমোদন হয়েছে, তবে অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব হচ্ছে।


বোর্ডের অচলাবস্থা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব এই দুটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হলেও সচিব (সদস্যসচিব) নেতৃত্ব দেন। সাধারণত সরকার-সমর্থক শিক্ষকনেতারাই সচিবের পদে থাকেন। সরকার পরিবর্তনের পর পূর্ববর্তী সচিবরা কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন, ফলে প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও নতুন বোর্ড গঠন করা সম্ভব হয়নি।


বর্তমানে অবসর সুবিধা বোর্ডের রুটিন সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক মো. জাফর আহম্মদ। তিনি জানান, আগে অনুমোদিত অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে, তবে গত আগস্ট থেকে কোনো বৈঠক হয়নি। কল্যাণ ট্রাস্টের অবস্থাও করুণ; রুটিন দায়িত্বে থাকা মো. আবুল বাশার সম্প্রতি অবসর-উত্তর ছুটিতে চলে যাওয়ায় কার্যত কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নেই। ফলে কাগজপত্রে অনুমোদন থাকলেও অর্থ ছাড়ে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দিয়েছে।


সমাধান হিসেবে দুই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। অবসর ও কল্যাণ সুবিধার অর্থের মূল উৎস শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে কাটা অর্থ। বর্তমানে অবসর সুবিধার জন্য মূল বেতনের ৬ শতাংশ এবং কল্যাণ সুবিধার জন্য ৪ শতাংশ কাটা হয়। মাসিকভাবে প্রায় ৭০ কোটি টাকা অবসর তহবিলে এবং ৩ কোটি টাকা এফডিআর লভ্যাংশ থেকে আসে। অথচ অবসর সুবিধা দিতে প্রতি মাসে ১১৫ কোটি টাকা প্রয়োজন হয়, যার ফলে মাসিক ঘাটতি দাঁড়ায় ৪২ কোটি টাকা বা বার্ষিক ৫০৪ কোটি টাকা।


বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানান, এখনই সব অনিষ্পন্ন আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লাগবে। এরপর স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রতিবছর ৫০০ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দিলে আর কোনো শিক্ষক-কর্মচারীকে দীর্ঘ অপেক্ষার শিকার হতে হবে না। কল্যাণ ট্রাস্টের ক্ষেত্রেও অনিষ্পন্ন আবেদন নিষ্পত্তিতে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা এককালীন প্রয়োজন এবং এরপর প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে।


শিক্ষক-কর্মচারীদের দুর্ভোগ কমাতে অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি বোর্ড পুনর্গঠনও জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আইন অনুযায়ী শিক্ষকদের মধ্য থেকে বোর্ড গঠন করা হলে প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হবে এবং সমস্যা সমাধানের পথ সুগম হবে।


thebgbd.com/NIT