ঢাকা | বঙ্গাব্দ

সাবেক সেনাপ্রধানের দৃষ্টিতে চব্বিশের ‘আধা-বিপ্লব’ বেহাত হলো যেভাবে

জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে লেখেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ৩টি গণঅভ্যুত্থান দেখেছে।
  • নিজস্ব প্রতিবেদক | ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
সাবেক সেনাপ্রধানের দৃষ্টিতে চব্বিশের ‘আধা-বিপ্লব’ বেহাত হলো যেভাবে সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে যারা শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে আন্দোলনের দিক পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া।


২০১২ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এই জেনারেল নিজের ফেসবুকে তুলে ধরেছেন আলোচিত সে সময়ের নানা ঘটনাপ্রবাহ। তার দৃষ্টিতে কেমন ছিল চব্বিশের বিপ্লব?


জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে লেখেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ৩টি গণঅভ্যুত্থান দেখেছে। সেসব গণঅভ্যুত্থানে সেনাবাহিনী কখনোও বিপ্লবী জনতার পাশে থেকেছে, কিংবা কখনও নিরপেক্ষ থেকেছে।


৩টি গণঅভ্যুত্থানের প্রথমটি ঘটে ১৯৭১ সালে। এরপর হয়েছে ১৯৯০ এবং সবশেষ ২০২৪ সালে। তবে ২৪’এর বিপ্লবকে ‘আধা-বিপ্লব’ বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। সেই সাথে বিপ্লবীরা কীভাবে নতুন ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের সুযোগ হারালো, সে বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি।


পোস্টে তিনি বলেন, ২০২৪ সালে ৩য় প্রধান ঘটনাটি ঘটে, যাকে ‘আধা-বিপ্লব’ বলা যেতে পারে। কারণ, পুরোপুরি বিকশিত হবার আগেই ফ্যাসিবাদী সরকারের সংবিধান, রাষ্ট্রপতি ও সামরিক বাহিনী মিলে একে আটকে দেয়। বঙ্গভবনকে বড় ধরনের বিপ্লবের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়।


২৪-এর বিপ্লব ঘিরে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করা এখনও কেন সম্ভব নয়, তার ব্যাখ্যাও দেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। তিনি জানান, সেনাবাহিনীর অবস্থান খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।


সেই সঙ্গে কিছু প্রশ্নও সামনে আনেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা হলো, শেখ হাসিনা কীভাবে পালিয়ে গেলেন। এছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং পুলিশ কীভাবে ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় পেলেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সব তথ্যের ঘাটতি পূরণ হলে মিলবে সেনাবাহিনীর প্রকৃত ভূমিকা।


জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া লিখেছেন, আজ পর্যন্ত ২০২৪ সালের জুন, জুলাই এবং আগস্টে কয়েক সপ্তাহব্যাপী চলা এই আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর সঠিক ভূমিকা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকারিভাবে কোন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। সেই সাথে সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরেও আনুষ্ঠানিকভাবে কোন তদন্ত আদালত গঠন করা হয়নি। ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা তথ্যের টুকরো মিললেও, সেগুলো দিয়ে সেনাবাহিনীর আসল আচরণ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়নি। এজন্য এ বিপ্লবকে ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের সাথে তুলনা করা কষ্টকর।


আন্দোলনের সময় নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক প্রোফাইলের কাভার ও প্রোফাইল ছবি ‘লাল’ করার প্রসঙ্গও তুলে ধরেছেন জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। তার এই পদক্ষেপ সেসময় যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। সাথে এটাও জানান, অনুরোধের পরেও আগের প্রোফাইলের ছবিতে না ফেরায় তার ওপর বিরক্ত হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।


জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া লিখেছেন, ‘নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম দমন-পীড়ন, বিশেষ করে আবু সাঈদের নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে কয়েক রাত নির্ঘুম কাটানোর পর আমি তাদের অনুরোধ রাখতে মনস্থির করি। কিন্তু নিজে তেমন প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন না হওয়ায়, ছোট মেয়েকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি কীভাবে ছবিটি পরিবর্তন করতে হয়। সে দ্রুতই লাল রঙের একটি গ্রাফিক পাঠায়, যেটি আমি আপলোড করি। তারিখ ছিল ৩১ জুলাই, ২০২৪।’


জেনারেল আরও বলেন, আমার ধারণা ছিল না, এই পদক্ষেপের প্রভাব কতটা গভীর হবে। মাত্র ৬ ঘণ্টায় উল্লেখযোগ্য সেনাসদস্যদের ফেসবুক প্রোফাইল ছবি লাল হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নির্দেশে তার সামরিক সচিব ফোন করে আমাকে অনুরোধ করেন আমি যেন আগের প্রোফাইলের ছবিতে ফিরি। আমি রাজি হইনি। এতে শেখ হাসিনা বিরক্ত হন। এরপর আমার সরকারি চাকরিজীবী আত্মীয়স্বজনদের দিকে নানা ধরনের হুমকি আসতে থাকে।


বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বিচক্ষণতার প্রশংসা করে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া বলেন, মোড় ঘুরে যায় ৩ আগস্ট বেলা দেড়টায় যখন জেনারেল ওয়াকার সেনাপ্রাঙ্গণে জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, কেননা নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশে তারা বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাদের অসন্তোষ অনুভব করে জেনারেল ওয়াকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তাদের পক্ষে দাঁড়ান। তারপরে যদিও বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গায় গুলির ঘটনা ঘটে, যেমন যাত্রাবাড়ীতে। অন্যত্র গুলির মাত্রা অনেকটাই কমে আসে।


ক্ষমতাসীন দলের ভীত কীভাবে নড়ে গেলো, সে বিষয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। রাওয়াতে তাদের ব্রিফিংটি শেখ পরিবারকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।


দেশ থেকে পালিয়ে যাবার একদিন আগেও শেখ হাসিনা অবসরপ্রাপ্ত এই জেনারেলকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সহিংসতার নানা ছবি পাঠান এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন বলে দাবি করেন জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া।


তিনি পোস্টে লিখেন, ৪ আগস্ট থেকেই শেখ হাসিনা আমাকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সহিংসতার নানা ছবি পাঠাতে শুরু করেন এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। আমি ফোনে সাড়া দেইনি। ৭ আগস্টের পর ছবি পাঠানো বন্ধ করেন তিনি। শুধু ২৭ অক্টোবর শেষবারের মতো একটি ভিডিও পাঠান।


শেষ মুহূর্তে আরও একটি মরিয়া চেষ্টা করেন শেখ হাসিনা বলে উল্লেখ করেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। পোস্টে জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া লেখেন, ৪ আগস্ট রাতে (প্রায় ১১ টায়) গণভবনে সব নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের ডেকে শেখ হাসিনা নির্দেশ দেন, বিক্ষোভকারীদের যে কোনো মূল্যে দমাতে হবে। এজন্য একটি বিশদ পরিকল্পনা করা হয়। বিজিবি, র‍‍্যাব ও পুলিশকে ঢাকার ১৩টি প্রবেশপথ আটকে দিতে বলা হয় এবং সেনাবাহিনীকে শহরের প্রধান এলাকাগুলো দখলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সেনাপ্রধান বুদ্ধিমত্তার সাথে এমনভাবে সেনা মোতায়েন করেন, যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি কম থাকে। তিনি জানতেন যে বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই গুলি চালাতে নারাজ।


তিনি আরও লেখেন, ৫ আগস্ট অসংখ্য মানুষ ঢাকায় ঢুকতে শুরু করলে, বাইরের দিকে অবস্থান নেয়া বিজিবি, র‍‍্যাব ও পুলিশ বাধা না দিয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়। শহরের ভেতরে থাকা সেনা ইউনিটগুলোও জনতার সাথে মিশে গিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করে। গণভবন দখল হয়, আর শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে দেশ ছাড়েন। কয়েক মুহূর্তের জন্য জনতাকে থামিয়ে রাখা হয়, যাতে তিনি নিরাপদে হেলিকপ্টারে নিরাপদে দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন।


২৪ জানুয়ারি একটি পোস্ট করে এই সাবেক জেনারেল লিখেছেন, শেষ দৃশ্যটা ঘটে সেনাসদরে যেখানে সেনাপ্রধান এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানরা—মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর (বিএনপি) ও ডিজি ডিজিএফআই মেজর জেনারেল হামিদের মাধ্যমে—পাঁচটি রাজনৈতিক দল আর আইন শিক্ষক আসিফ নজরুলকে ডেকে পাঠান (এটি ছিল একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ।যেখানে বিজিতদের বিজয়ীদের কাছে যাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো বিজয়ীরা রিজিতদের কাছে রিপোর্ট করে)। শোনা যায়, সেখানে রাজনীতিবিদরা ও আসিফ নজরুল সেনাপ্রধানের রাষ্ট্রপতি ও সংবিধান বহাল রেখে, আগের তত্বাবধায়ক (caretaker)-এর আদলে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশ চালানোর পরামর্শ মেনে নেন।


পরে জনসম্মুখে সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ ঘোষণা করেন এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন। এরপর বঙ্গভবনে, যেখানে ছাত্রনেতারাও উপস্থিত ছিলেন, ড. ইউনুসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ঠিক করা হয়। যে বিপ্লব জোরালোভাবে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত একটি “অকাল সিজার” এর মতো জটিল কৌশলের মাধ্যমে অনেকটাই মিইয়ে যায়—কিছু ক্ষমতাবান লোক মূল নাটের গুরু হিসেবে থেকে যান।


পোস্টে তিনি আরও লিখেন, যদি আদর্শভাবে ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের ন‍্যায় এই বিপ্লব সম্পূর্ণ সাফল্য পেতে চাইত, তাহলে হয়তো গণভবন ও বঙ্গভবন একযোগে দখল হতো, বিদ্যমান সংবিধান ছিঁড়ে ফেলা হতো, আর আগের শাসনের সহায়তায় যেসব ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন, তাদের সবাই হয় দেশছাড়া হতেন বা বিচার মুখোমুখি হতেন। গড়ে উঠত একটি বিপ্লবী পরিষদ, যারা নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার এবং গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করত। তারপর নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফেরা যেত। কিন্তু অনভিজ্ঞ বিপ্লবী নেতৃত্ব পুরনো পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে পূর্ববর্তী ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ে। নতুন কোনো ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ তারা তাই হারিয়ে ফেলে। এপরিস্থিতিতে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয় যার ফাক দিয়ে অন্য বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া শূন‍্য জুতোয় পা গলিয়ে দ্রুত আরেকটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে দ্রুত ধাবমান হয়।




thebgbd.com/AR