সমুদ্রের অতলে সূর্যের রশ্মি পৌঁছোয় না এমন জায়গায় বাস। সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠে আসার ইতিহাস সে ভাবে নেই। মাসখানেক আগে অদ্ভুতদর্শন এমনই এক মাছের দেখা মিলেছিল স্পেনীয় দ্বীপ টেনেরিফের কাছে। নাম হাম্পব্যাক অ্যাংলারফিশ। এরা বেশি পরিচিত ‘ব্ল্যাক সি ডেভিল’ নামে। ভয়ঙ্করদর্শন মাছটির রং কুচকুচে কালো। চোয়ালে অজস্র ধারালো দাঁত, মাথার উপর শুঁড়, ঘোলাটে চোখ। বদখত দেখতে মাছটি যেন সত্যিই সামুদ্রিক দানব।
পৃথিবীর ইতিহাসে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার মাছটিকে ক্যামেরাবন্দি করা গিয়েছে। ২০১৪ সালে মাছটির একটি ভিডিও প্রকাশ্যে আসে। সে সময়ও মাছটির ভিডিও ব্যাপক ভাইরাল হয়। তবে শুধু অ্যাংলারফিশ নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সমুদ্রের অন্ধকার থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠে আসতে দেখা গিয়েছে বেশ কয়েকটি অদ্ভুতদর্শন প্রাণীকে। সচরাচর এই সব প্রাণীর দেখা সমুদ্রপৃষ্ঠে মেলে না। কিন্তু কেন তা নিয়ে চিন্তায় বিজ্ঞানীদের একাংশ। তার আগে দেখে নেওয়া যাক অ্যাংলারফিশ বা ‘ব্ল্যাক সি ডেভিল’ ছাড়া সমুদ্রের গভীরে বাস করা আর কোন কোন প্রাণীকে সম্প্রতি উপরে উঠে আসতে দেখা গিয়েছে।
আটলান্টিক, প্রশান্ত এবং ভারত মহাসাগরের ৫০০ থেকে ৪৫০০ মিটার গভীরে খোঁজ মেলে ‘ব্ল্যাক সি ডেভিল’-এর। মাছটি প্রায় সম্পূর্ণ অন্ধকারে বেড়ে ওঠে। খুব সহজে হাম্পব্যাক অ্যাংলারফিশের দেখা মেলে না। হাম্পব্যাক অ্যাংলারফিশ তার অদ্ভুত চেহারার জন্য পরিচিত। রাক্ষুসে সেই মাছটির মাথা বড় হলেও দেহ ছোট। মাথায় অ্যান্টেনার মতো একটি শুঁড় রয়েছে, যা সমুদ্রের অতলে শিকারকে আকর্ষণ করতে ব্যবহার করে এরা।
হাম্পব্যাক অ্যাংলারফিশ সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০০-৪০০০ ফুট নীচে ‘মেসোপেলাজিক’ অঞ্চলে বাস করে। তাই তাদের দেখা পাওয়া খুবই বিরল ঘটনা। ২০১৪ সালে হাওয়াই উপকূলের পর ২০২৫ সালে আবার স্পেনের এক দ্বীপের কাছে দেখা মিলেছে মাছটির। ‘মন্টেরি বে অ্যাকোয়ারিয়াম রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ গবেষণার জন্য মাছটিকে ধরেছে। অ্যাংলারফিশ দেখতে ভয়ঙ্কর হলেও আকারে খুব একটা বড় হয় না। স্ত্রী অ্যাংলারফিশ পুরুষের চেয়ে তুলনায় বড়। গভীর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে মাছটির। সাধারণত অন্য ছোট মাছ এবং স্কুইড শিকার করে সমুদ্রের শয়তান।
এর পর তালিকায় রয়েছে জায়ান্ট অরফিশ। ‘সমুদ্র সাপ’ বা ‘ডুম্সডে ফিশ’ নামে পরিচিত অরফিশ। সম্প্রতি মেক্সিকোর এক সৈকতে দেখা মিলেছে মাছটির। গত ১০ ফেব্রুয়ারি সমুদ্রসৈকতে ভেসে ওঠে মাছটি। অ্যাংলারফিশের মতো অরফিশ অতটা খারাপ দেখতে নয়। রুপোলি রঙের ছিপছিপে মাছটি দেখতে ধাতব চাবুকের মতো। পাখনার রং কমলা। অরফিশও গভীর জলের মাছ। সে-ও সমুদ্রের ‘মেসোপেলাজিক’ অঞ্চলে বাস করে।
ফলে খুব কমই সমুদ্রেপৃষ্ঠের কাছাকাছি দেখা যায় অরফিশকে। তবে আকস্মিক ভাবে মাছটি সমুদ্রের উপরে উঠে আসায় আলোচনা শুরু হয়েছে। সেই ঘটনা উস্কে দিয়েছে কিছু ভয়ঙ্কর পৌরাণিক কাহিনিকেও। ফলে মাছটিকে আপাতত ‘ডুম্সডে ফিশ’ নামেই ডাকছেন অনেকে। জাপানের লোককথায় অরফিশ পরিচিত ‘রিউগু নো সুকাই’ বা ‘সমুদ্র ঈশ্বরের বার্তাবাহক’ নামে। খারাপ বা বিধ্বংসী কিছু হতে চললে তবেই নাকি উপরে উঠে আসে মাছটি। ধ্বংসের বার্তা দিয়ে যায়। আর সে কারণেই ওই মাছটিকে ‘ধ্বংসের দিনের মাছ’ বলে উল্লেখ করছেন অনেকে।
সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ সালে জাপানের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পরে গভীর সমুদ্রে বসবাসকারী প্রায় ২০টি অরফিশ দেশটির উপকূলে ভেসে ওঠে। এর পর ২০১৩ সালে, ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্রসৈকতে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিটার লম্বা একটি অরফিশ ভেসে উঠে। বিজ্ঞানীদের অবাকও করে দেয় মাছটি। ২০১৭ সালে ফিলিপাইনেও দেখা যায় মাছটিকে।
বিজ্ঞানীমহলের দাবি, ভূমিকম্পের কারণে চাপের পরিবর্তন হলে সমুদ্রের গভীরে থাকা প্রাণীদের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে এবং তারা সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি চলে আসে। আবার ভূমিকম্পের আগে প্রচুর পরিমাণে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস নিঃসৃত হওয়ার কারণেও সমুদ্রের অতলে থাকা অনেক মাছ উপরে উঠে আসে। ‘ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ অনুযায়ী, অরফিশ দৈর্ঘ্যে ছয় মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে সক্ষম। বেশ কিছু বিজ্ঞানী সেই মাছ এবং ভূমিকম্পের কার্যকলাপের মধ্যে একটি সম্ভাব্য যোগসূত্র স্বীকার করেন।
এর পরে তালিকায় রয়েছে গবলিন হাঙর। প্রাগৈতিহাসিক চেহারার হাঙরটির দেখা মেলে সমুদ্রের হাজার মিটার গভীরে। গবলিন হাঙরও ভয়ঙ্করদর্শন। ২০১৪ সালে ফ্লোরিডার কি ওয়েস্টে একটি মাছ ধরার ডকের কাছে দেখা যায় হাঙরটিকে। গবলিন হাঙরের উদ্ভট চেহারা, দীর্ঘ মুখ এবং প্রসারিত চোয়াল যে কাউকে ভয় ধরিয়ে দিতে পারে। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস ছিল, ট্রলারের কারণে গভীর সমুদ্রে ঘটা কোনও দুর্ঘটনা বা সমুদ্রের স্রোতের কারণে এটি বাধ্য হয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠে আসে।
গভীর সমুদ্রে থাকা একটি বিশেষ জেলিফিশ বা স্টিজিওমেডুসা গিগান্টিয়াও ২০২২ সালে ভেসে উঠে। স্টিজিওমেডুসা গিগান্টিয়া বিশ্বের বিরল জেলিফিশগুলির মধ্যে অন্যতম। সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠের ১০০০ থেকে ৪০০০ মিটার গভীরে বাস এদের। ২০২২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরি বে উপকূলের কাছাকাছি এই বিশাল জেলিফিশের দেখা মেলে। জেলিফিশটির লম্বা, ফিতের মতো বাহুগুলি ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা ছিল। সামুদ্রিক প্রাণীটিকে দেখার পর বিজ্ঞানীমহলে আলোচনার ঝড় উঠে।
ফ্রিল্ড হাঙরও রয়েছে এই তালিকায়। ফ্রিল্ড হাঙরকে জীবন্ত জীবাশ্ম হিসাবে বিবেচনা করা হয়। গভীর সমুদ্রের বিশেষ প্রজাতির এই হাঙর আকারে অন্য হাঙরদের মতো বড় না হলেও দেখতে ভয়ঙ্কর। ফ্রিল্ড হাঙরের শরীর ইলের মতো হলেও মাথা হাঙরের মতো। ২০০৭ সালে জাপানের এক মৎস্যজীবী একটি ফ্রিল্ড হাঙর ধরেন। বিশেষজ্ঞদের দাবি, গভীর সমুদ্রে অসুস্থ হয়ে সেটি সমুদ্রের উপরের দিকে উঠে আসে।
সূত্র: ইনডিপেন্ডেন্ট
এসজেড