টার প্রধান নির্বাহী ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের এক ঐতিহাসিক অ্যান্টিট্রাস্ট (বাজার প্রতিযোগিতা বিরোধী) মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট ফেসবুক (বর্তমানে মেটা) ইন্সটাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপকে প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার আগেই কিনে নিয়ে বাজারে তার প্রভাব খাটিয়েছে।
ওয়াশিংটন থেকে এএফপি জানায়, ফেডারেল ট্রেড কমিশনের (এফটিসি) আইনজীবীরা যুক্তি দিয়েছেন, ফেসবুক প্রতিযোগিতামূলক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে এসব প্রতিষ্ঠানকে গিলে খেয়েছে। জাকারবার্গকে আদালতে ২০১১ সালের একটি অভ্যন্তরীণ ই-মেইল দেখানো হয়, যেখানে বলা হয়, স্মার্টফোনে ইন্সটাগ্রাম জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং এটি সহজেই ফেসবুকের সেবাগুলোর অনুকরণ করতে পারবে।
২০১২ সালের আরেকটি ই-মেইলে ইন্সটাগ্রাম অধিগ্রহণের প্রসঙ্গে বলা হয়, অ্যাপটি বন্ধ না করে চলমান রাখার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছিল, যেন ব্যবহারকারীদের বিরক্ত না করা হয় এবং ফেসবুক নিজের পণ্যগুলো উন্নয়ন করতে পারে। জাকারবার্গ এই আদান-প্রদানগুলোকে তখনকার প্রাথমিক আলোচনা বলে উল্লেখ করেন, যা ইন্সটাগ্রাম অধিগ্রহণ পরিকল্পনার আগে হয়।
ওয়াশিংটনের একটি ফেডারেল আদালতে মামলার শুরুতে জাকারবার্গের আশা ছিল, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার দায়িত্বে ফিরে আসায় হয়তো বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকার অ্যান্টিট্রাস্ট আইনের প্রয়োগে নমনীয় হবে। কিন্তু সেই আশা ভেস্তে গেছে। এই মামলায় মেটাকে ইন্সটাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে বাধ্য করা হতে পারে, যেগুলো অধিগ্রহণের পর মেটা এখন বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
মামলার শুরুতে এফটিসির আইনজীবী ড্যানিয়েল ম্যাথেসন বলেন, ‘ওরা মনে করেছে, প্রতিযোগিতা কঠিন ব্যাপার—এর চেয়ে বরং প্রতিদ্বন্দ্বীদের কিনে নেওয়াই সহজ।’ অন্যদিকে, মেটার আইনজীবী মার্ক হ্যানসেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে আইনের চোখে কোনো প্রতিষ্ঠানকে কিনে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ ঘটানো অবৈধ নয়—এটাই ফেসবুক করেছে।’
ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ছায়া
২০২০ সালের ডিসেম্বর ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম মেয়াদেই মেটার বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তখন থেকেই নজর ছিল, ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে এলে তিনি এফটিসিকে পেছনে টানবেন কি না। বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি জাকারবার্গ বারবার হোয়াইট হাউস পরিদর্শন করেছেন ট্রাম্পকে বোঝাতে যে মামলার বদলে সমঝোতায় পৌঁছানো উচিত।
লবিংয়ের অংশ হিসেবে তিনি ট্রাম্পের অভিষেক তহবিলে অনুদান দিয়েছেন, কনটেন্ট মডারেশনের নীতিমালাও বদলেছেন। এমনকি রাজনৈতিক কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকার উদ্দেশ্যে ওয়াশিংটনে ২ কোটি ৩০ লাখ ডলারের একটি বাড়িও কিনেছে। এই মামলায় জাকারবার্গের সাবেক সহকারী শেরিল স্যান্ডবার্গ ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা সাক্ষ্য দেবেন বলে জানা গেছে। মামলাটি কমপক্ষে আট সপ্তাহ ধরে চলতে পারে।
মামলার কেন্দ্রে রয়েছে ২০১২ সালে এক বিলিয়ন ডলারে ফেসবুকের ইন্সটাগ্রাম অধিগ্রহণ—তখন এটি ছিল একটি সম্ভাবনাময় ছোট ছবি ভাগাভাগির অ্যাপ, যা এখন ২০০ কোটির বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারীর একটি প্ল্যাটফর্ম। এফটিসি আদালতে একটি ই-মেইল উপস্থাপন করেছে যেখানে জাকারবার্গ ইন্সটাগ্রামকে ‘ভয়ঙ্কর উদীয়মান’ হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বলেন, ‘এই কারণেই হয়তো অনেক টাকা দিয়ে কিনে নেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে।’
২০১৪ সালে ১৯ বিলিয়ন ডলারে হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণও একই প্যাটার্নে হয়েছে বলে এফটিসির অভিযোগ। তারা বলেছে, জাকারবার্গ ভেবেছেন, হোয়াটসঅ্যাপ হয়তো নিজেই একটি সামাজিক নেটওয়ার্কে রূপান্তরিত হবে কিংবা অন্য কোনো প্রতিযোগী এটি কিনে নিতে পারে।
মেটার আইনজীবীরা পালটা যুক্তি দিয়েছেন, এই দুটি অধিগ্রহণে বিশাল বিনিয়োগের ফলে প্ল্যাটফর্ম দুটি আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে। তারা আরও বলেছে, মেটার অ্যাপগুলো ব্যবহারকারীদের জন্য বিনামূল্যে এবং তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে রয়েছে। এফটিসির দাবি, মেটার একাধিপত্যের প্রমাণ হলো, প্রযুক্তি পণ্যে বিরক্তিকর পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা বিনষ্ট করা।
মামলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে—মেটার বাজার কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বলছে, ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার অ্যাপ হিসেবে একচেটিয়া অবস্থানে রয়েছে—এই ক্যাটাগরিতে টিকটক ও ইউটিউব পড়ে না।
কিন্তু মেটা একমত নয়। মেটার এক মুখপাত্র বলেন, ‘এই মামলায় প্রমাণিত হবে যে প্রতিটি ১৭ বছরের তরুণ জানে—ইন্সটাগ্রাম, ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ টিকটক, ইউটিউব, এক্স, আইমেসেজসহ বহু প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে।’ আইনজীবী ব্রেন্ডান বেনেডিক্ট সাবস্ট্যাকে বলেন, ‘মেটা যত বড় করে বাজারের সংজ্ঞা দিতে পারবে, এফটিসির মামলা হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাও তত বাড়বে।’
সূত্র: এএফপি
এসজেড