বিশ্বব্যাপী ৮৪ শতাংশ প্রবালপ্রাচীরকে এক নজিরবিহীন প্রবাল ব্লিচিং (রং হারানো) পরিস্থিতি আক্রান্ত করেছে। বিজ্ঞানীরা বুধবার সতর্ক করে বলেছেন, মানুষের তৈরি এই সংকট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, যা বিপুল পরিমাণ প্রবাল-আবাস ধ্বংস করে দিতে পারে।
প্যারিস থেকে এএফপি জানায়, ২০২৩ সালের শুরুর দিকে শুরু হওয়া এ প্রবাল ব্লিচিং এখন পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পরিণত হয়েছে। প্রশান্ত, ভারত ও আটলান্টিক মহাসাগরের প্রবালপ্রাচীরগুলো এই সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তীব্র তাপমাত্রার কারণে প্রবাল সাদা হয়ে যায়, এবং গত দুই বছরে মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে মহাসাগরের তাপমাত্রা রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা জানান, তীব্র তাপপ্রবাহ প্রবালপ্রাচীরগুলোকে সুস্থ হয়ে ওঠার সময় দিচ্ছে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) জানিয়েছে, কিছু অঞ্চলে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে এটি ‘একাধিক প্রজাতি কিংবা সম্পূর্ণ প্রবালপ্রাচীরকে ধ্বংসের’ মুখে ঠেলে দিতে পারে। ক্যারিবীয় অঞ্চলে কাজ করা ‘হেলদি রিফস ফর হেলদি পিপল’ উদ্যোগের বিজ্ঞানী মেলানি ম্যাকফিল্ড বলেন, ‘যখন একটার পর একটা তাপপ্রবাহ আসে, তখন সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়।’
যখন প্রবাল তাদের শরীরের ভেতরের রং, পুষ্টি ও শক্তির উৎস শৈবাল ত্যাগ করে, তখনই ব্লিচিং ঘটে, অর্থাৎ প্রবাল বিবর্ণ বা সাদা হয়ে যায়। এতে প্রবাল দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক প্রবালপ্রাচীর উদ্যোগ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ১৯৫০ সালের পর থেকে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত ক্ষতির কারণে জীবিত প্রবালের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বিজ্ঞানীরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছালে পৃথিবীর ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ প্রবালপ্রাচীর হারিয়ে যেতে পারে—যা পরিবেশ ও মানবজীবনের জন্য এক মারাত্মক বিপর্যয়। প্রবালপ্রাচীর শুধু সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য নয়, উপকূলবর্তী কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকার সহায়ক—খাদ্য, ঝড় থেকে সুরক্ষা ও পর্যটন শিল্পে তা অপরিহার্য।
প্রবাল সংকটের ইতিকথা
প্রথমবারের মতো ব্যাপক প্রবাল ব্লিচিং দেখা যায় ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে। তখন থেকে এটি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের একটি দৃশ্যমান ও উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি হচ্ছে ইতিহাসের চতুর্থ ও সবচেয়ে বড় ব্লিচিং, এবং গত এক দশকের মধ্যে দ্বিতীয়—২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে।
এনওএএ জানিয়েছে, ‘২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত, বিশ্বের ৮৩.৭ শতাংশ প্রবালপ্রাচীর তীব্র তাপমাত্রার চাপে পড়েছে।’ জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে অতিরিক্ত যে তাপ উৎপন্ন হয়েছে, তার ৯০ শতাংশই মহাসাগর শোষণ করেছে। এ উষ্ণতা প্রবাল ব্লিচিংয়ের প্রধান কারণ।
অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের জলবায়ুবিজ্ঞানী অ্যালেক্স সেন গুপ্ত বলেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানির নির্গমন ও প্রবাল মৃত্যুর মধ্যে সরাসরি ও অস্বীকারযোগ্য নয় এমন সম্পর্ক রয়েছে।’ বর্তমান বিপর্যয়ের মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে এনওএএ তাদের প্রচলিত ব্লিচিং সতর্কতা স্কেলে তিনটি নতুন ধাপ যুক্ত করতে বাধ্য হয়েছে। সেন গুপ্ত বলেন, 'এটা এমন, যেন প্রবালের জন্য ঘূর্ণিঝড় স্কেলে ‘ক্যাটাগরি-৬’ ও ‘ক্যাটাগরি-৭’ যোগ করতে হয়েছে।'
গণমৃত্যুর নজির
ম্যাকফিল্ড জানান, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হন্ডুরাস উপকূলে একটি বিখ্যাত প্রবালপ্রাচীর ৪৬ শতাংশ জীবিত প্রবাল নিয়ে টিকে ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা মাত্র ৫ শতাংশে নেমে আসে—'আমরা কখনও এমন গণমৃত্যু দেখিনি।'
ইউরোপীয় জলবায়ু পর্যবেক্ষণ সংস্থা কোপারনিকাস জানিয়েছে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ইতোমধ্যে প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১.৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, ১.৫ ডিগ্রির সীমা আগামী এক দশকের শুরুতেই অতিক্রম হয়ে যেতে পারে। আর তা যদি ২ ডিগ্রি ছাড়ায়, প্রবালপ্রাচীর প্রায় সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বর্তমান নীতিমালাগুলো পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হলেও, ২১০০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা ৩.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছতে পারে বলে আশঙ্কা।
সূত্র: এএফপি
এসজেড