প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ক্যানসারের চিকিৎসা থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন পর্যন্ত—যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা ক্ষেত্রকে আমূল পাল্টে দিচ্ছে। এতে বৈজ্ঞানিক নেতৃত্বের জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হুমকির মুখে পড়েছে, আর চাকরি ও অর্থায়ন নিয়ে গভীর শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ওয়াশিংটন থেকে এএফপি জামায়, দেশের খ্যাতনামা ফেডারেল সংস্থাগুলোতে ব্যাপক ছাঁটাই। গবেষণা অনুদানে শত শত কোটি ডলারের ছাঁটাই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর প্রকাশ্য হুমকি, লিঙ্গ বা মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতাুসম্পর্কিত শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা—এসব ঘটেছে মাত্র প্রথম ১০০ দিনের মধ্যেই। ‘এটা একদম বিশাল মাত্রার,’ বললেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সমাজ ও বিজ্ঞানের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ক বিভাগের প্রধান পল এডওয়ার্ডস। তিনি এএফপিকে বলেন, ‘আমার ৪০ বছরের পেশাজীবনে যুক্তরাষ্ট্রে এমন কিছু দেখিনি।’
বিজ্ঞান ও একাডেমিক মহলে এ উদ্বেগ বেশ বিস্তৃত। মার্চের শেষে, ন্যাশনাল অ্যাকাডেমিজ অব সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিনুএর নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে ১,৯০০ জনের বেশি খ্যাতনামা বিজ্ঞানী এক খোলা বিবৃতিতে সতর্ক সংকেত জারি করেন। তারা বলেন, কোন গবেষণায় অর্থায়ন হবে বা কোন গবেষণা প্রকাশ পাবে তা আর্থিক চাপ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হলো মূলত একধরনের সেন্সরশিপ এবং এটা বিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য—সত্যের অনুসন্ধান—কে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
‘দেশের বৈজ্ঞানিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে,’ তারা লেখেন। প্রশাসনের প্রতি তাদের আহ্বান, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানকে ধ্বংস করার এ হামলা বন্ধ করুন’ এবং জনসাধারণকেও তাদের সঙ্গে যোগ দিতে আহ্বান জানান।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদকালেও বিজ্ঞান মহল একটি ‘আসন্ন হামলা’র ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু এখন যা ঘটছে, তা আরও ব্যাপক ও সুসংগঠিত। 'এটা নিশ্চিতভাবেই বড়, আরও সংগঠিত,' বললেন ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েন্টিস্টস-এর সায়েন্স অ্যান্ড ডেমোক্রেসি সেন্টারের পরিচালক জেনিফার জোনস। তিনি বলেন, প্রশাসন পুরোপুরি ‘প্রজেক্ট ২০২৫’ নামের রূপরেখা অনুসরণ করছে।
এই অতিরক্ষণশীল পরিকল্পনায়—যা ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে জোরেশোরে অনুসরণ করছেন—প্রধান বৈজ্ঞানিক ও একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন বা ভেঙে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) আছে, যাকে ‘জলবায়ু আতঙ্কবাদ’ ছড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
ট্রাম্পের কর্মকর্তারা এসব মতই তুলে ধরছেন। স্বাস্থ্য সচিব রবার্ট কেনেডি জুনিয়র, যিনি টিকাবিরোধী মনোভাবের জন্য পরিচিত, বিজ্ঞান নিয়ে জনগণের অবিশ্বাসকে আরও বাড়িয়ে তুলেছেন—বিশেষত কোভিড-১৯ মহামারির সময়। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শীলা জাসানোফ বলেন, এর ফলে জ্ঞান উৎপাদনের সঙ্গে রাষ্ট্রের এক নীরব চুক্তি ছিল, সেটাই ভেঙে পড়ছে।
হার্ভার্ড এখন একাডেমিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের অভিযানের প্রধান লক্ষ্য। বিশ্ববিদ্যালয়টি অনুদান স্থগিত, করমুক্ত মর্যাদার ওপর হুমকি এবং বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে সীমাবদ্ধতার মতো নানা চাপে পড়েছে—যা ‘এন্টিসেমিটিজম’ ও ‘ওয়োক’ মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মোড়কে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। জাসানোফ বলেন, ‘বিজ্ঞানের প্রতি এই ক্রোধ আমার কাছে কট্টর ধর্মীয় উন্মাদনার মতো মনে হয়।’
এই পরিবর্তনের মুখে বহু গবেষক এখন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়ার কথা ভাবছেন। এতে মেধা-পলায়নের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যার সুযোগ নিতে চাইছে অন্যান্য দেশ। ফ্রান্সে সংসদ সদস্যরা ‘বৈজ্ঞানিক উদ্বাস্তুর’ জন্য বিশেষ মর্যাদার একটি বিল উত্থাপন করেছেন। কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়বেন, তবে অনেকেই হয়তো একেবারেই হাল ছেড়ে দেবেন, এমন আশঙ্কা করছেন ইউনিভার্সিটি অব মেইনের জলবায়ু বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল স্যান্ডউইস। তিনি বলেন, এতে একপ্রজন্মের প্রতিশ্রুতিশীল গবেষক হারিয়ে যেতে পারে।
‘এই যে উঠতি গবেষক, ভবিষ্যতের তারকারা, তাদের অনেককেই আমরা হারাব,’ তিনি বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শিল্প—বিশেষ করে ওষুধশিল্প—এই প্রতিভার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখন, জোনস বলেন, ‘আসল গবেষণা বাদ দিয়ে তারা হয়তো যাচাইবিহীন ছদ্মবিজ্ঞান ও অবিশ্বস্ত গবেষকদের দিয়ে সেই শূন্যস্থান পূরণ করবে।’
এমনই একজন ডেভিড গিয়ের, একজন টিকাবিরোধী কর্মী যিনি আগে চিকিৎসকের লাইসেন্স ছাড়াই চিকিৎসা সেবায় অভিযুক্ত হন। তাকে নিয়োগ দিয়েছেন রবার্ট কেনেডি জুনিয়র, টিকা ও অটিজমের মধ্যে বাতিল হয়ে যাওয়া সম্পর্ক খতিয়ে দেখার জন্য—যাকে সমালোচকরা পক্ষপাতদুষ্ট গবেষণার পথ বলে মনে করছেন। জোনস বলেন, ‘এই প্রশাসন যে মাত্রার বিভ্রান্তি ও ভ্রান্ত তথ্য ছড়াচ্ছে, তা কাটিয়ে উঠতে আমাদের হয়তো বছর নয়—প্রজন্ম পার হয়ে যাবে।’
সূত্র: এএফপি
এসজেড