মস্কোর হাতে ক্রিমিয়া ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি ‘শান্তি চুক্তি’ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানোর কয়েক ঘণ্টা পর ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত দুইজন নিহত এবং ডজনখানেক মানুষ আহত হয়েছেন। কিয়েভ শহরে বৃহস্পতিবার ভোরে ‘শত্রুপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্রের’ হামলা হয়। শহরজুড়ে ড্রোনের গমগম শব্দ শুনতে পান এএফপির সাংবাদিকরা। লোকজন তখন বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে সরে যান।
কিয়েভের মেয়র ভিতালি ক্লিৎসকো জানান, হামলায় এখন পর্যন্ত দুইজন নিহত ও ৫৪ জন আহত হয়েছেন। তার ভাষায়, ‘আহতদের মধ্যে ৩৮ জনকে, যাদের মধ্যে ছয়জন শিশু রয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিদের ঘটনাস্থলেই চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।’ পূর্ব ইউক্রেনের খারকিভ শহরেও সাতটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। শহরটির মেয়র ইগর তেরেখোভ জানান, ‘শহরের ওপর ড্রোন দিয়ে বড় ধরনের হামলা চলছে।’ তিনি টেলিগ্রামে লেখেন, ‘সবাই সাবধান থাকুন!’
ইউক্রেনের কর্তৃপক্ষ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সতর্কতা জারি করে। এএফপি সাংবাদিকরা রাজধানী জুড়ে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। নগরীর সামরিক কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রামে জানান, ‘কিয়েভ শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে।’ এর কিছুক্ষণ পর কিয়েভের মেয়র ভিটালি ক্লিটসকো জানান, ‘রাজধানীতে দুইজন নিহত হয়েছে।’ তিনি এক টেলিগ্রাম পোস্টে বলেন, ‘৫৪ জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬ শিশুসহ ৩৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এএফপি’র প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাংবাদিক জানান, বিমান হামলার সতর্কতা শুরু হওয়ার পর একটি আবাসিক ভবনের বেসমেন্টে স্থাপিত একটি আশ্রয়কেন্দ্রে এক ডজনেরও বেশি বাসিন্দা জড়ো হন।
এর কয়েক ঘণ্টা আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের জানান, শান্তিচুক্তি ‘খুব কাছাকাছি’ এবং কার্যত মস্কোর সঙ্গে সম্পন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি অভিযোগ করেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ‘চুক্তিতে পৌঁছাতে আরও কঠিন হয়ে উঠেছেন।’
২০২২ সালে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া যুদ্ধ শেষ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, জেলেনস্কি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। ট্রাম্প বলেন, ‘এই অস্বীকৃতি কেবল ‘মৃত্যুর ময়দান’ দীর্ঘায়িত করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেছে। এখন আমাদের জেলেনস্কির সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। ভেবেছিলাম, জেলেনস্কির সঙ্গে বোঝাপড়া সহজ হবে। এখন পর্যন্ত তা কঠিন প্রমাণিত হয়েছে।’
ট্রাম্পের এই বক্তব্যের আগে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স জানান, ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে শান্তিচুক্তির মানে হলো—ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল ইতিমধ্যে রাশিয়ার দখলে গেছে, সেগুলো মেনে নেওয়া। তবে জেলেনস্কি এ ধরনের প্রস্তাবকে ইউক্রেনের সংবিধানের লঙ্ঘন হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর জবাবে ট্রাম্প তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেন, জেলেনস্কি ‘উস্কানিমূলক’ আচরণ করছেন এবং ‘রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনার জন্য ক্ষতিকর অবস্থান’ নিয়েছেন।
ট্রাম্প ট্রুথ সোশালে লেখেন, ‘জেলেনস্কি চাইলে শান্তি পেতে পারে, অথবা সে তিন বছর ধরে লড়াই চালিয়ে গিয়ে পুরো দেশটাই হারাতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ক্রিমিয়া বহু আগেই হারানো হয়েছে। এটা আলোচনার বিষয়ই নয়।’ জবাবে জেলেনস্কি সোশাল মিডিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও-র ২০১৮ সালের ‘ক্রিমিয়া ঘোষণা’ পোস্ট করেন, যেখানে লেখা ছিল, ‘ক্রিমিয়া সংযুক্ত করার রাশিয়ার চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করে।’
রুশ হামলার মধ্যে জেলেনস্কির প্রধান উপদেষ্টা আন্দ্রি ইয়ারমাক টেলিগ্রামে লিখেছেন, ‘এই মুহূর্তে রাশিয়া কিয়েভ, খারকিভসহ বিভিন্ন শহরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে হামলা চালাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘পুতিনের উদ্দেশ্য একটাই—হত্যা। আগুন থামাতে হবে। সাধারণ মানুষের ওপর হামলা বন্ধ করতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় চলমান প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘প্রচণ্ড রকম বিরক্ত হয়ে পড়েছেন’, বলেন হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট। ট্রাম্প বারবার প্রচারণায় বলেছেন, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যেই’ তিনি এই যুদ্ধ শেষ করবেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এখন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের ওপর চুক্তি গ্রহণের জন্য প্রবল চাপ দিচ্ছে। তবে রাশিয়ার ওপর কোনো দৃশ্যমান চাপ দেননি ট্রাম্প। তিনি বরং মস্কোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন, যদি যুদ্ধ বন্ধ হয়।
এদিকে ভারতের সফরে গিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার সবচেয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘বর্তমান সীমান্তরেখা স্থির থাকবে।’ ভ্যান্স বলেন, ‘ইউক্রেন এবং রাশিয়া—উভয়কেই তাদের কিছু ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে হবে।’ এর মানে হলো—ফ্রন্টলাইনে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে ইউক্রেনের বড় অংশ রাশিয়ার দখলে থেকে যাবে।
তবে ভ্যান্স বলেননি, রাশিয়া—যারা ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে—তারা কিসের বিনিময়ে কিছু ছাড় দেবে। তিনি বলেন, ‘এখন সময় এসেছে মস্কো ও কিয়েভের স্পষ্ট ‘হ্যাঁ’ বলার, নতুবা যুক্তরাষ্ট্রকে এই প্রক্রিয়া থেকে সরে যেতে হবে।’ ওয়াশিংটন যদি রাশিয়ার দখলে থাকা ক্রিমিয়াকে স্বীকৃতি দেয়—এই সম্ভাবনায় ইউরোপীয় রাজনীতিকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রাঁর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, ‘ইউক্রেনের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং ইউরোপীয় অভিযাত্রা—এই দুটি বিষয় ইউরোপের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কেবল ইউক্রেনই ঠিক করবে।’ বুধবার লন্ডনে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ব্রিটেনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক দফা আলোচনা শেষ করেছে ইউক্রেনের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এই সপ্তাহে মস্কো সফরে যাবেন। ট্রাম্প জানিয়েছেন, মে মাসের মাঝামাঝি মধ্যপ্রাচ্য সফর শেষে তিনি সম্ভবত রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এই কূটনৈতিক তৎপরতা এবং কিয়েভে রুশ হামলা এমন সময় ঘটল, যখন ইস্টার উপলক্ষে স্বল্প সময়ের যুদ্ধবিরতি ভেঙে দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের মারগানেতস শহরে রাশিয়া নতুন করে বিমান হামলা চালায়। এতে নয়জন নিহত এবং অন্তত ৩০ জন আহত হন।
এই হামলার প্রেক্ষিতে জেলেনস্কি ‘তাৎক্ষণিক, পূর্ণাঙ্গ ও নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি’র আহ্বান জানিয়েছেন।
সূত্র: এএফপি
এসজেড