ঢাকা | বঙ্গাব্দ

গাজা প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো

১৫ সদস্যের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পরিষদের বাকি ১৪টি দেশ পক্ষে ভোট দিয়েছে।
  • অনলাইন ডেস্ক | ০৫ জুন, ২০২৫
গাজা প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো যুক্করাষ্ট্রের ভেটো।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তার ওপর সব বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আনা এক খসড়া প্রস্তাবকে বুধবার ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গাজায় ‘তাৎক্ষণিক, নিঃশর্ত এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির’ আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। 


বুধবার (৪ জুন) এই ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৫ সদস্যের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পরিষদের বাকি ১৪টি দেশ পক্ষে ভোট দিয়েছে। এই খসড়া প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১৪টি দেশের সমর্থন পেলেও  ভেটোক্ষমতাধারী একমাত্র সদস্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভোট দেয়। ‘গার্ডিয়ানের’ একটি প্রতিবেদনে এই খবর জানা গেছে।


জাতিসংঘ সদরদপ্তর থেকে সিনহুয়া জানায়, প্রস্তাবটিতে হামাসসহ অন্যান্য গোষ্ঠীর হাতে আটক সব বন্দির অবিলম্বে ও নিঃশর্ত মুক্তি এবং গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশ ও এর নিরাপদ বিতরণের ওপর আরোপিত সব বাধা তাৎক্ষণিক ও নিঃশর্তভাবে তুলে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। ভেটো দেওয়া প্রস্তাবে গাজার পরিস্থিতিকে ‘বিপর্যয়কর’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে এবং ‘গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশ এবং জাতিসংঘ এবং মানবিক অংশীদারদের দ্বারা এর নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন বিতরণের ওপর সমস্ত নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে তুলে নেওয়ার’ দাবি করা হয়েছে। 


ইসরায়েলকে রক্ষা করার জন্য এটি পঞ্চমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের খসড়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। বাইডেন প্রশাসনের অধীনে নভেম্বরে ওয়াশিংটন একই ধরণের একটি প্রস্তাব ভেটো দেয়। কারণ, যুদ্ধবিরতির দাবি হামাস কর্তৃক আটক সকল জিম্মির তাৎক্ষণিক এবং নিঃশর্ত মুক্তির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। আলজেরিয়া, ডেনমার্ক, গ্রীস, গায়ানা, পাকিস্তান, পানামা, দক্ষিণ কোরিয়া, সিয়েরা লিওন, স্লোভেনিয়া এবং সোমালিয়া এই প্রস্তাবের সহ-স্পন্সর করে। রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যও পক্ষে ভোট দিয়েছে। 


জাতিসংঘে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত জেরোম বোনাফন্ট বলেছেন, ‘আমাদের বেশিরভাগই একই দৃষ্টিভঙ্গিতে একত্রিত হচ্ছে বলে মনে হলেও কাউন্সিলকে তার দায়িত্ব পালন করতে বাধা দেওয়া হয়।’ ভোটাভুটির ফলাফলের পর জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি ফু কং বলেন, ‘আজকের ভোটের ফলে চীন গভীরভাবে হতাশ। খসড়া প্রস্তাবটিতে গাজার মানুষের সবচেয়ে জরুরি দাবি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রবল ইচ্ছাশক্তির প্রতিফলন ঘটেছে।’


তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আবারও ভেটো ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, গাজার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে নৃশংসভাবে বিনষ্ট করেছে এবং দুই মিলিয়নের বেশি মানুষকে অন্ধকারেই ফেলে রেখেছে।’ ফু আরও বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদের গাজা সংঘর্ষ বন্ধে ব্যর্থতার মূল কারণই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বারবার বাধা প্রদান। একটি মাত্র স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের ভেটো শান্তির অগ্রযাত্রাকে থামাতে পারবে না।’


যুক্তরাজ্যের অবস্থান


যুক্তরাজ্য এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে। যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড ইসরায়েলের নতুন সাহায্য ব্যবস্থাকে ‘অমানবিক’ বলে অভিহিত করেছেন এবং খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়ে বলেন, ‘গাজার অসহনীয় পরিস্থিতি শেষ হওয়া প্রয়োজন। ইসরায়েল সরকার যে মাত্রায় সামরিক অভিযান বাড়িয়েছে এবং যেভাবে মানবিক সহায়তা আটকে রেখেছে, তা অগ্রহণযোগ্য, অমার্জনীয় ও ফলপ্রদ নয়।’ তিনি বলেন, ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা নতুন ব্যবস্থায় সাহায্য পৌঁছার পথ খুলেছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ক্ষুধার্ত মানুষ যখন সাহায্যের আশায় এগিয়ে যায়, তখন তাদের ওপর গুলি চালানো হয়। এটা অমানবিক।’


যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড বলেছেন, ইসরায়েলের ‘এখনই সাহায্যের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নেয়া উচিত।’ তিনি বলেছেন, ‘গাজায় সামরিক অভিযান সম্প্রসারণ এবং সাহায্য কঠোরভাবে সীমিত করার ইসরায়েলি সরকারের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বিপরীতমুখী। এবং যুক্তরাজ্য তাদের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে।’


যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য


নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভূটির পর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মার্কো রুবিও এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আজ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজায় ইসরাইলকে লক্ষ্য করে একটি প্রতিকূল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠিয়েছে।’ তিনি বলেছেন, ওয়াশিংটন এমন কোনো প্রস্তাবকে সমর্থন করবে না যা ‘ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে মিথ্যা সমতা তৈরি করে অথবা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে অবজ্ঞা করে। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে ইসরায়েলের সঙ্গে থাকবে।’ 


ইসরায়েল ভেটোকে স্বাগত জানিয়েছে। ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিয়ন সার এক্সে এক বার্তায় লিখেছেন, ‘জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এই একতরফা প্রস্তাবে ইসরায়েলের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানোর জন্য এবং ভেটো দেওয়ার জন্য মার্কিন প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই। প্রস্তাবিত প্রস্তাবটি কেবল হামাসকে শক্তিশালী করে এবং জিম্মি চুক্তি অর্জনের জন্য আমেরিকান প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে।’ 


নিরাপত্তা পরিষদের অন্যান্য সদস্যরা ভেটো দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন। জাতিসংঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ব্যর্থ প্রস্তাবটি ‘এই পরিষদের বিবেকের ওপর কেবল একটি নৈতিক দাগই থাকবে না, বরং রাজনৈতিক প্রয়োগের একটি দুর্ভাগ্যজনক মুহূর্ত যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রতিধ্বনিত হবে।’ 


জাতিসংঘে চীনের রাষ্ট্রদূত ফু কং বলেছেন, ‘আজকের ভোটের ফলাফল আবারও প্রকাশ করে যে গাজায় সংঘাত নিরসনে কাউন্সিলের অক্ষমতার মূল কারণ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার বার বাধা।’ দীর্ঘ সময় ধরে সাহায্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং মার্কিন ও ইসরাইলি সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামক একটি প্রকল্পের অস্থির বাস্তবায়নের পর জাতিসংঘ এবং সাহায্য সংস্থাগুলো গাজায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করার পর এই প্রস্তাবটি ভোটের জন্য উত্থাপন করা হয়েছিল। রাফায় মানবিক সাহায্য গ্রহণের জন্য জড়ো হওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি বাহিনী গুলি চালানোর ঘটনায় প্রাণ গেছে বিপুল সংখ্যাক লোকের। গাজার নাসের হাসপাতালে একজন আহত মেয়েকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। 


বুধবার জাতিসংঘের ত্রাণ প্রধান টম ফ্লেচার বলেছেন, ‘গাজার একটি খাদ্য কেন্দ্রে ফিলিস্তিনিদের হত্যা সম্পর্কে আমরা যা জানি ‘বিশ্ব দিনের পর দিন দেখছে, ফিলিস্তিনিদের খাওয়ার চেষ্টা করার সময় গুলি করা, আহত করা বা হত্যা করার ভয়াবহ দৃশ্য’। রাজনৈতিক সমর্থন এবং তহবিলের অস্পষ্টতা রয়েছে এমন জিএইচএফ ঘোষণা করেছে  বৃহস্পতিবার সকালে গাজায় তাদের বিতরণ কেন্দ্রগুলো দ্বিতীয় দিনের জন্য বন্ধ থাকবে। মঙ্গলবার জিএইচএফ বিতরণ কেন্দ্রে খাবারের জন্য অপেক্ষা করার সময় ইসরাইলি গুলিতে কমপক্ষে ২৭ জন নিহত এবং শত শত আহত হয়েছে। 


জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি বারবারা উডওয়ার্ড জানিয়েছেন, ‘জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ‘এই ঘটনাগুলোর অবিলম্বে স্বাধীন তদন্ত এবং অপরাধীদের জবাবদিহি করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।


আলজেরিয়ার বক্তব্য


আলজেরিয়ার রাষ্ট্রদূত আমার বেনজামা বলেন, 'এই প্রস্তাব শুধু কয়েকটি দেশের কণ্ঠস্বর নয়, বরং গোটা বিশ্বের সম্মিলিত ইচ্ছা। এটি ফিলিস্তিনিদের প্রতি একটি বার্তা, ‘তোমরা একা নও।’ আর ইসরায়েলি দখলদারদের জন্য একটি সতর্কতা, ‘বিশ্ব তোমাদের দেখছে।’ তিনি বলেন, ‘এই প্রস্তাবপত্র এমনকি ভেটোর মাধ্যমে আটকে গেলেও বহুপ্রান্তিক ব্যবস্থার অনিঃশেষ ব্যথার প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকবে।’


পাকিস্তানের তীব্র প্রতিবাদ


পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আসিম ইফতিখার আহমদ বলেন, ‘এটি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কজনক দিন। গাজায় দুই মিলিয়নের বেশি মানুষের জীবন নিয়ে এমন অবজ্ঞাসূচক বার্তা গভীর উদ্বেগজনক।’ তিনি বলেন, ‘এই ব্যর্থতা শুধু একটি প্রক্রিয়াগত বিষয় নয়; এটি ভবিষ্যতে জবাবদিহি, ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষার পথেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। এই মুহূর্তটিকে মনে রাখা হবে একটি যুগান্তকারী রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে, যেখানে পরিষদের সবচেয়ে বড় দায়িত্বে আবারও একটি সদস্য বাধা হয়ে দাঁড়াল।’


সূত্র: গার্ডিয়ান, সিনহুয়া


এসজেড