ঢাকা | বঙ্গাব্দ

জবানবন্দিতে সাবেক সিইসি, রাতের ভোট নিয়ন্ত্রণ করে এনএসআই-ডিজিএফআই

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | ০৩ জুলাই, ২০২৫
জবানবন্দিতে সাবেক সিইসি, রাতের ভোট নিয়ন্ত্রণ করে এনএসআই-ডিজিএফআই ফাইল ছবি

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সরাসরি হস্তক্ষেপে ভোটের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয় এবং গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। তিনি বলেন, এই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি পরে বুঝতে পারেন এবং কমিশনের সদস্যদের অন্ধকারে রেখে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছিল।


‘দিনের ভোট রাতে’ করার অভিযোগে বিএনপির দায়ের করা মামলায় গত ২২ জুন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন নূরুল হুদা। পরদিন আদালতে তিনি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচন বিতর্কিত হলেও এর দায় নির্বাচন কমিশনের নয়। এরপর দুই দফায় তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন। একই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন আরেক সাবেক সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।


নূরুল হুদা জবানবন্দিতে বলেন, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে পুলিশের কিছু অসৎ কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং অনিয়মের মাধ্যমে ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নিয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, “নির্বাচনের পরে রেজাল্ট শিট দেখে দেখি, অনেক কেন্দ্রে ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে। রাতেই ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে।”


তিনি আরও বলেন, “গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই এবং ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল বলে আমি পরে বুঝতে পারি। নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে আমি বিশ্বাস করি যে নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়ম হয়েছে। দিনের ভোট রাতে হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ আগের দিনই ব্যালট পেপার ভর্তি করে দিয়েছে বলেও শুনেছি।” তিনি জানান, পুলিশের সহযোগিতা না পাওয়া এবং বিএনপির নেতা–কর্মীদের গণগ্রেপ্তারের অভিযোগ পেয়েছিলেন।


ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদিন ও মেজর জেনারেল (অব.) টি এম জুবায়েরের ভূমিকার দিকেও ইঙ্গিত করেন তিনি। দুদক ইতিমধ্যে তাদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তদন্ত করছে এবং তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ ও বিদেশযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।


জবানবন্দিতে নূরুল হুদা বলেন, “আমি বা আমার কমিশনের লোকদের অন্ধকারে রেখে এই অরাজক পরিস্থিতি ও ভোটের অনিয়ম করা হয়েছিল। গেজেট প্রকাশের পর আমাদের নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা ছিল না, তাই কিছুই করতে পারিনি। যারা ক্ষমতায় ছিল এবং পরে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে, সেসব বেনিফিশিয়ারি সেন্ট্রালি অর্গানাইজড হয়ে টাকা বিতরণ ও দিনের ভোট রাতে করেছে বলে আমার বিশ্বাস।”


তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলাল উদ্দিন আহমেদের ভূমিকা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি মাঠ পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম ছিলেন। নূরুল হুদা আরও জানান, তার ভাগিনা এস এম শাহজাদা নৌকা প্রতীক নিয়ে পটুয়াখালী-৩ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং আত্মীয়তার কারণে কিছু প্রাধান্য পেয়েছেন বলেও মনে করেন।


তার আইনজীবী ওবায়দুল ইসলাম বলেন, “হয়রানি করার জন্য নূরুল হুদাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।” তবে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, ভোটে অনিয়মের তথ্য জেনেও কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে নূরুল হুদা নির্বাচন সম্পন্ন করেন এবং শেখ হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় বসান।


ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার শাসনামলে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনই বিতর্কিত হয়েছে—২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল একতরফা, ২০১৮ সালের নির্বাচন পরিচিত ‘রাতের ভোট’ হিসেবে এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন ‘ডামি ভোট’ নামে সমালোচিত।


এই তিনটি নির্বাচনে ওঠা অভিযোগ তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকার ২৬ জুন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির সদস্য মো. আবদুল আলীম বলেন, “নূরুল হুদা পদত্যাগ করলে হয়তো হেনস্তা হতে পারতেন, কিন্তু তিনি জাতির কাছে নায়ক হয়ে থাকতেন।” তিনি জানান, তদন্ত কমিটি শিগগিরই কাজ শুরু করবে।


thebgbd.com/NIT