ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতার চূড়ার খুব কাছাকাছি ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। তেহরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে তিনি নির্বাচিত হতে পারেন— সেই হিসাবই কষা হচ্ছিল মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। কিন্তু আকস্মিক দুর্ঘটনা পাল্টে দিয়েছে সেই সমীকরণ। অবসান ঘটিয়েছে আয়াতুল্লাহ খামেনির চেয়ারে রাইসিকে দেখার জল্পনার। রোববার একটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন অনেকদিন ধরে আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের জাঁদরেল নেতা ইব্রাহিম রাইসি।
ঘটনাটি তেহরানের নীতি অথবা ইসলামি প্রজাতন্ত্রে কোনো গুরুতর ঝাঁকুনি দেবে বলে মনে করা হচ্ছে না। তবে পরীক্ষার মুখোমুখি করে দেবে রক্ষণশীল ব্যবস্থাকে।
চ্যাথাম হাউস থিংক ট্যাংকের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির পরিচালক ড. সানাম ভাকিল বলেন, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাইসির মৃত্যুর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেললেও সাংবিধানিক পদ্ধতি মেনে চলবে। পাশাপাশি এমন একজনেরও খোঁজ চালানো হবে; যিনি খামেনির প্রতি আনুগত্য দেখাবেন এবং রক্ষণশীল ঐক্য বজায় রাখতে পারবেন।
তার বিরোধীরা অবশ্য ১৯৮০-এর দশকে রাজনৈতিক বন্দিদের গণমৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে নির্ধারকের ভূমিকা পালন করার অভিযোগে অভিযুক্ত এই সাবেক প্রসিকিউটরের প্রস্থানকে স্বাগত জানাবে। যদিও রাইসি তার বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগ বরাবর অস্বীকার করে এসেছেন। অন্যদিকে তার বিরোধীরা এটাও আশা করবে, ইব্রাহিম রাইসির প্রস্থান রক্ষণশীল শাসন ব্যবস্থার অবসান ত্বরান্বিত করবে।
ড. সানাম ভাকিল মনে করেন— রাইসির শেষ বিদায় ক্ষমতাসীনদের জন্য আবেগে ভরা একটি উপলক্ষ হবে। এর মাধ্যমে রক্ষণশীলরা যে শাসন চালিয়ে যেতে প্রস্তুত; সে বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে সংকেত পাঠানোর শুরু করারও সুযোগ পাবে। কারণ তারা জানে- গোটা বিশ্ব তাদের ওপর নজর রাখছে।
তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মারান্দি বলেছেন, পশ্চিমাদের ভাষ্যমতে- ইরানের পতন হওয়ার হবে। তারা ভেঙে পড়বে। এটা কয়েক বছর ধরেই তারা বলছিল। কিন্তু অলৌকিকভাবে, এটি এখনও আছে এবং আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি- এটি আগামী বছরগুলোতেও থাকবে।
আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ পদ যা অবশ্যই পূরণ করতে হবে এবং সেটি হলো বিশেষজ্ঞদের সমাবেশে এই মাঝারি পদমর্যাদার ধর্মগুরুর আসন। সময় এলে একজন নতুন শীর্ষ নেতা বেছে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে এই মণ্ডলীর।
ড. ভাকিল বলেন, ‘রাইসি একজন সম্ভাব্য উত্তরসূরি ছিলেন। কারণ খামেনি নিজে যখন শীর্ষ নেতা হয়েছিলেন; সে সময় তিনিও তুলনামূলকভাবে তরুণ ছিলেন, ভীষণ অনুগত, ব্যবস্থাপনার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন; যার ব্যাপক পরিচিতিও ছিল। রাইসিও তাই।’
তবে সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার তালিকায় আরও বেশ কিছু নাম রয়েছে। যেখানে আছেন শীর্ষ নেতার ছেলে মোজতাবা খামেনিও।
রাইসির মৃত্যু আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হওয়ার আগেই আয়াতুল্লাহ এক্স (সাবেক টুইটারে)-এ একটি পোস্টে জানিয়েছিলেন, ‘ইরানি জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়, দেশের কার্যক্রমে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না।’
তবে এই মুহূর্তে ইরানের জন্য রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ হলো রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আয়োজন করা। যদিও ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবেরের কাছে ইতোমধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু আগামী ৫০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে দেশটিকে।
এদিকে গেল মার্চেই অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচন। কয়েক মাস পরেই ভোটারদের কাছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আবার ভোট দেওয়ার সুযোগ এসেছে। যদিও মার্চ মাসে ওই দেশে সবচেয়ে কম ভোট পড়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। অথচ ইরানের নাগরিকরা এক সময় নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় উৎসাহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতেন। বিষয়টি তাদের কাছে গর্বেরও ছিল।
২০২১ সালের নির্বাচন, যেবার ইব্রাহিম রাইসি রাষ্ট্রপতি হন, সেটিসহ সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে তদারকি সংস্থা দ্বারা মধ্যপন্থী এবং সংস্কারপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বীদের পদ্ধতিগতভাবে বাদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।
লন্ডনভিত্তিক সংবাদ সংস্থার ওয়েবসাইট আমওয়াজ ডট মিডিয়ার সম্পাদক মোহাম্মদ আলী শাবানি বলেন, সময়ের আগেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া খামেনি ও রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়কে ভোটারদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনার একটা সুযোগ দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন পর্যন্ত আমরা এমন কোনো ইঙ্গিত দেখিনি; যা থেকে বলা যেতে পারে রাষ্ট্র এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত বা ইচ্ছুক।
বার্লিনভিত্তিক থিংক ট্যাংক এসডব্লিউপির ভিজিটিং ফেলো হামিদরেজা আজিজি বলেন, ইব্রাহিম রাইসির পদমর্যাদারও সুস্পষ্ট কোনো উত্তরসূরি দেখা যাচ্ছে না। এই রক্ষণশীল গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন শিবির রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আরও কট্টরপন্থী আর বাকিদের তুলনামূলকভাবে বাস্তববাদী বলে মনে করা হয়।
আজিজি মনে করেন— নতুন সংসদে এবং স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার লড়াই শিগগিরই আরও বেশি জোরদার হয়ে উঠবে। ইব্রাহিম রাইসির দায়িত্ব যে ব্যক্তিই গ্রহণ করুন, তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে একটি নিষিদ্ধ এজেন্ডা নেবেন।
ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা শীর্ষ নেতার হাতে। এই অঞ্চলের পররাষ্ট্রনীতি, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) সংরক্ষণ তাদের হাতে যারা ক্রমবর্ধমানভাবে শক্তির প্রয়োগ করে। বলা হয়— ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধ নিয়ে মাসখানেক আগে ইসরায়েলের সঙ্গে নজিরবিহীন সংঘর্ষের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি কিন্তু সিদ্ধান্ত নেননি।
‘আঘাতের বদলে আঘাত’ এই নীতি অনুসরণ একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বিশেষত তেহরানে তীব্র বিপদের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব দেখা যায় ব্যবসা-বাণিজ্যে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। এর পাশাপাশি দেশের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে তীব্র অর্থ কষ্টের সঙ্গে লড়তে হয় তাদের। কারণ সে সময় ৪০ শতাংশের বেশি মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে; রিয়ালের মুদ্রার মান কমেছে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইরানের কঠোর পোশাকবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে নীতি পুলিশের হাতে ২২ বছরের মাহসা আমিনের মৃত্যুর পর শুরু হওয়া ব্যাপক বিক্ষোভের ঢেউ দেখেও ইসলামিক প্রজাতন্ত্র কেঁপে উঠেছিল। ওই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগে রাইসি ইরানের ‘হিজাব আইন’ কঠোর করার নির্দেশ দেন।
ওই আইনে নারীদের হিজাব পরা, ‘শালীন আচরণ ও পোশাক’ পরার বাধ্যবাধ্যকতার বিষয়ে উল্লেখ ছিল। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের নারীরা তাদের জীবনের ওপর জোর করে আরোপ করা বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। শীর্ষ নেতা এবং দেশের ব্যবস্থার উপর ক্ষোভ উগরে দেন তারা। মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী— সে সময় বিক্ষুব্ধদের দমন করতে চালানো অভিযানে শয়ে শয়ে মানুষ নিহত হয়েছেন। আটক করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে।
সংস্কারপন্থী নেতা হাসান রুহানির কথা উল্লেখ করে শাবানি বলেন, ইরানের ইতিহাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পড়ার নজির সৃষ্টি হয় রাইসির নির্বাচনের সময়। তিনি কিন্তু তার পূর্বসূরি রুহানির মতো জনপ্রিয়তা পাননি। হাসান রুহানি মূলত জনপ্রিয়তা পান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০১৫ সালে পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই পিছু হটে যাওয়ায় ওই চুক্তি শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন ও রাইসির টিমের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনার খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।
শাবানি ব্যাখ্যা করেছেন— রুহানির প্রতি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বিরোধীদের ক্রোধ এড়াতে পেরেছেন রাইসি। এর আংশিক কারণ তাকে অপেক্ষাকৃতভাবে কম প্রভাবশালী এবং কার্যকর হিসাবে দেখা হয়েছে।
রোববার হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির আব্দুল্লাহিয়ানও প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি তেহরানের বিষয়টা বিশ্বের কাছে তুলে ধরার বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। একই সঙ্গে ইরানের উপর জারি হওয়া নিষেধাজ্ঞার শাস্তিমূলক প্রভাব কমানোর উপায় খুঁজে বের করেছিলেন। ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধকে ঘিরে জরুরি কূটনীতির সময়, ইরানের মিত্রদের পাশাপাশি আরব ও পশ্চিমা পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন আব্দুল্লাহিয়ান।
পশ্চিমা এক জ্যেষ্ঠ কূটনৈতিক সূত্র দাবি করেছে— বার্তা পাঠানোর জন্য জরুরি চ্যানেল ছিলেন আব্দুল্লাহিয়ান। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ক্ষমতা না থাকায় বিষয়টা সূত্রমাফিক চলত।
বোর্স অ্যান্ড বাজার থিংক ট্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এসফানদিয়ার ব্যাটমানঘেলিজ বলেন, একজন রাষ্ট্রপতির আকস্মিক মৃত্যু সাধারণত একটি পরিণতিমূলক ঘটনা; কিন্তু সম্ভাব্য শীর্ষ নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও তার রাজনৈতিক সমর্থন এবং স্পষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল। কিন্তু যে রাজনৈতিক নেতারা রাইসিকে ক্ষমতায় এনেছিলেন, তারা তাকে ছাড়াই এবার এগিয়ে যাবেন।
সূত্র: বিবিসি