ঢাকা | বঙ্গাব্দ

প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা অমান্য, ধ্বংস করা হচ্ছে করে সুন্দরবনের শুঁটকি মাচা

স্থানীয় কয়েকজন জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জোয়ারের সময় খালে ফাঁদ পেতে ভাটার সময় কীটনাশক ছিটিয়ে মাছ ধরেন চক্রের সদস্যরা।
  • নিজস্ব প্রতিবেদক | ২৮ জুলাই, ২০২৫
প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা অমান্য, ধ্বংস করা হচ্ছে করে সুন্দরবনের শুঁটকি মাচা ফাইল ছবি

সুন্দরবনে প্রজনন মৌসুমের কারণে প্রতিবছর জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সকল ধরনের বনজ সম্পদ আহরণ ও পর্যটন কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকে। এ সময়ে মাছ, কাঁকড়া, মধু, গোলপাতা ও কাঠ সংগ্রহ বন্ধ থাকায় বন থাকে নির্জন। এমনকি সাধারণ বনজীবীদের বনের অভ্যন্তরে প্রবেশও নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র বনরক্ষী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালনের জন্য প্রবেশ করতে পারেন।


তবে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি গোপনে সুন্দরবনের গহীনে বিষ দিয়ে মাছ ধরাসহ অবৈধভাবে শুঁটকি তৈরির কাজে লিপ্ত হচ্ছে। বন বিভাগের তথ্য মতে, চলতি জুলাই মাসেই পূর্ব সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় শুঁটকি তৈরির বেশ কিছু মাচা ধ্বংস ও শুঁটকি জব্দ করেছে বনরক্ষীরা।


২৩ জুলাই চাঁদপাই রেঞ্জের চরাপুটিয়ার শিয়ালা খালের মুখে অভিযান চালিয়ে ২ বস্তা শুঁটকি, ৩টি নৌকা ও ৩টি ড্রাম জব্দসহ একটি শুঁটকি ঘর গুঁড়িয়ে দেয় বনরক্ষীরা। এর আগে ১৫ জুলাই একই এলাকায় ৪টি শুঁটকি ঘর ধ্বংস ও ২০ বস্তা শুঁটকি জব্দ করে চাঁদপাই রেঞ্জের স্মার্ট টিম-১। ১৪ জুলাই শরণখোলা রেঞ্জের বড় কেচুয়া খাল এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরও একটি শুঁটকি ঘর ধ্বংস করা হয়। ১২ জুলাই হাড়বাড়িয়ার বড় ডাবুর খালের মুখ থেকে ১৮ বস্তা শুঁটকি ও দুটি নৌকা জব্দ করা হয়েছে।


স্থানীয় কয়েকজন জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জোয়ারের সময় খালে ফাঁদ পেতে ভাটার সময় কীটনাশক ছিটিয়ে মাছ ধরেন চক্রের সদস্যরা। এরপর বনভূমিতে গাছ কেটে তৈরি করা হয় খোলা স্থান। সুন্দরী, পশুর ও গেওয়া গাছের কাঠ পুড়িয়ে তৈরি মাচায় বিষমিশ্রিত চিংড়ি ও মাছ শুকিয়ে শুঁটকি বানানো হয়।


জানা যায়, বিষমিশ্রিত এই শুঁটকি সরাসরি স্থানীয় বাজারে আনা হয় না। বনের গভীরেই শুকিয়ে গোপনে পাচার করা হয়। সুন্দরী গাছের কাঠে শুকানো শুঁটকি লালচে হওয়ায় বাজারে এর দামও বেশি। এজন্য সুন্দরী গাছ কাটা বেশি হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন এলাকায়ও পাচার হচ্ছে এসব শুঁটকি। সুন্দরবনের আংটিহারা রুটে চলাচলকারী কার্গো ও লাইটার জাহাজই এ পাচারের গোপন মাধ্যম।


জেলেরা আরও জানান, নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়ে শুধু অবৈধ চক্রের সদস্যরাই গোপনে বনে ঢুকে বিষ ছিটিয়ে চিংড়ি ধরে এবং মাচা তৈরি করে তা শুকিয়ে পাচার করে। অভিযোগ রয়েছে, এই চক্রের সাথে বনবিভাগের কিছু অসাধু সদস্যের মাসিক আর্থিক লেনদেন রয়েছে।


মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. শাহীন বলেন, বিষ দিয়ে ধরা মাছ খাওয়ায় শুধু বন্যপ্রাণী নয়, মানুষের শরীরেও এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। বিষাক্ত শুঁটকি খেয়ে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।


পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক দীপক চন্দ্র দাস বলেন, “কিছু অসাধু জেলে বনের গহীনে কীটনাশক ছিটিয়ে চিংড়ি ধরছেন। পরে গাছ কেটে আগুনে শুকিয়ে বানানো হচ্ছে শুঁটকি।”


পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “এই বন্ধ মৌসুমে আমরা অপরাধীদের স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছি না। টহল জোরদার করা হয়েছে, শুঁটকি মাচা বেশি ধ্বংস করা হচ্ছে। তবে গহীন বনে বিষ দিয়ে চিংড়ি ধরা এবং মাচা তৈরির প্রবণতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এতে বন ও জীববৈচিত্র্য দুটোই হুমকির মুখে পড়ছে।”


তিনি আরও জানান, জনবল সংকট ও প্রতিকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও বনবিভাগ সব ধরনের অপতৎপরতা ঠেকাতে কাজ করে যাচ্ছে।


thebgbd.com/NIT