ঢাকা | বঙ্গাব্দ

উসমানী খেলাফতের উসমান যেমন মানুষ ছিলেন

আতুগ্রুল ১২৫১ সালে নাইসিয়ান শহর থেবাসিওন জয় করেন। এর নতুন নামকরণ করা হয় সোগুত এবং এটি তার সাময়িক রাজধানী হয়। উসমান এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন।
  • | ০২ জুন, ২০২৪
উসমানী খেলাফতের উসমান যেমন মানুষ ছিলেন উসমানীয় অনুচিত্রে প্রদর্শিত প্রথম উসমান

উসমানী খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতার নাম উসমান গাজি। ১২৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাকে ‘উসমান আল্প’ তথা সৈনিক উসমানও বলা হয়। তার আরেক পরিচিতি ‘উসমান বে’। তুরস্কে ক্ষুদ্র কোনো জাতিগোষ্ঠীর নেতাকে ‘বে’ বলা হয়। ‘বে’ যেই গোষ্ঠী বা অঞ্চল বা প্রদেশ শাসন করতেন তাকে বলা হতো বেয়লিক। যেমন কায়ি বে অর্থ হলো- কায়িগোষ্ঠীর সর্দার। উসমানের বাবা আরতুগ্রুল এবং তার দাদা সোলেইমান শাহ কায়ি বেয়লিকের সর্দার বা ‘বে’ ছিলেন।

উসমানের বেয়লিকে বসার মধ্য দিয়ে উসমানি খেলাফত শুরু হয়। সেটি ছিল ১২৮৮ খ্রিষ্টাব্দ। সেই হিসেবে তিনি রাজ্য শাসন করেন ৩৭ বা ৩৮ বছর। তবে, আরেকটি মত হলো- উসমানের রাজত্বকাল ছিল ১৭ জানুয়ারি ১২৯৯ থেকে ২৯ জুলাই ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। অর্থাৎ উসমান সুলতান ছিলেন ২৭ বছর। যাই হোক, তখন থেকে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট ৩৭ শাসক ৬২৫ বছর উসমানি সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন।

উসমান গাজির স্বপ্ন


উসমান গাজি তৎকালীন বিখ্যাত শাইখ এদেবালিকে শ্রদ্ধা করতেন এবং তার মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। তিনি প্রায়ই এসকিশেহিরে গিয়ে এদেবালির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। এক রাতে একটি আশ্চর্যজনক স্বপ্ন দেখেন তিনি। সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে শাইখ এদেবালিকে তিনি বলেন, ‘আমার শাইখ, স্বপ্নে আমি আপনাকে দেখেছি। একটি চাঁদ আপনার বুকে দেখা দিয়েছে। এটি উঠতে থাকে এবং আমার বুকে এসে অবতীর্ণ হয়। আমার নাভি থেকে একটি গাছ উঠে। এটি বৃদ্ধি পায় এবং শাখা-প্রশাখা এত বেশি হয় যে এর ছায়া পুরো পৃথিবীকে আবৃত করে ফেলে। এই স্বপ্নের অর্থ কী?’ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর এদেবালি ব্যাখ্যা দেন: ‘অভিনন্দন উসমান! সর্বশক্তিমান আল্লাহ তোমার এবং তোমার বংশধরদেরকে সার্বভৌমত্ব প্রদান করেছেন। আমার কন্যা তোমার স্ত্রী হবে এবং সমগ্র বিশ্ব তোমার সন্তানদের নিরাপত্তাধীন হবে।’

সেই স্বপ্ন পরে সত্যে পরিণত হয়। উসমানের সঙ্গে শাইখ এদেবালির কন্যা বালা হাতুন বা মালা হাতুনের বিয়ে হয় এবং উসমানী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যেই সাম্রাজ্যের অধীনে পরবর্তীতে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, উত্তরে রাশিয়া কৃষ্ণ সাগর, পশ্চিম এশিয়া, ককেশাস, উত্তর আফ্রিকা ও আফ্রিকার শৃঙ্গজুড়ে, মধ্যপ্রাচ্য ও আরব অঞ্চলসহ বিস্তৃত একটি শক্তিশালী বহুজাতিক, বহুভাষিক অঞ্চল যুক্ত হয়। উসমানের সেদিনের সেই স্বপ্নকে উসমানি খেলাফত প্রতিষ্ঠার আসমানি ইশারা মনে করা হয়।

উসমানের বাবা আরতুগ্রুল গাজি উসমানি খেলাফতের স্বপ্নদ্রষ্টা

উসমানী খেলাফতের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন তারই বাবা আরতুগ্রুল গাজি। অঘুজ তুর্কি বংশোদ্ভূত এই লোকটি সবসময় ইসলামি খেলাফতের স্বপ্ন দেখতেন এবং নিজস্ব বাহিনী নিয়ে মঙ্গোলীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে খণ্ড খণ্ড অভিযান পরিচালনা করতেন। অনেকসময় সেলজুক সাম্রাজ্যের উজিরদের অনিয়মগুলোও তিনি রুখে দিতেন। ১২৯৯ সালে তিনি সেলজুক সাম্রাজ্য কর্তৃক উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়ার দায়িত্ব পান। ধীরে ধীরে একটি বড় স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। আরতুগ্রুল গাজি সেলজুক রাজবংশের জামাতাও ছিলেন। অর্থাৎ উসমানের মা হালিমে সুলতান ছিলেন সেলজুক সাম্রাজ্যের শাহজাদী।

উসমানের বেয়লিক


আতুগ্রুল ১২৫১ সালে নাইসিয়ান শহর থেবাসিওন জয় করেন। এর নতুন নামকরণ করা হয় সোগুত এবং এটি তার সাময়িক রাজধানী হয়। উসমান এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন। হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করেন তার জন্মের বছরেই। মোঙ্গল আগ্রাসন ও অভ্যন্তরীণ কলহ যখন বেড়ে যাচ্ছিল তখন উসমান বড় হতে থাকেন। তিনি ছোটকাল থেকেই চঞ্চল, বুদ্ধিমান ছিলেন। অল্প সময়েই তিনি অস্ত্র পরিচালনা ও যুদ্ধের কৌশল রপ্ত করেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলাফত পরিচালনার যোগ্যতাও তার মধ্যে দ্বীপ্তমান হতে থাকে। পিতার মৃত্যুর পর উসমান গাজি বেয়লিক প্রধান বা ‘বে’ হন। উসমান গাজী সেলজুক সুলতান প্রথম কায়কোবাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। সুলতান তাকে আনাতোলিয়ায় বেয়লিক প্রতিষ্ঠা এবং পশ্চিমে বাইজেন্টাইনদের দিকে সীমানা বৃদ্ধির অনুমতি প্রদান করেন।

এই সময় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সমগ্র ইসলামি জগত থেকে সৈনিকরা তার শাসনাধীন অঞ্চলে এসে জড়ো হন। এছাড়াও মোঙ্গলদের হাত থেকে বাঁচার জন্য অসংখ্য উদ্বাস্তু উসমানের আমিরাতে এসে আশ্রয় নেন, যাদের মধ্যে অনেক গাজি (যুদ্ধে অভিজ্ঞ) ছিল। উসমানের দক্ষ নেতৃত্বে এই যোদ্ধারা দ্রুত কার্যকর বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠে এবং এর ফলে সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়।

উসমানের যুদ্ধকৌশলের কাছে নতজানু হয়েছিল শত্রু বাহিনী। গুঁড়িয়ে পড়েছিল শত্রুদের দুর্ভেদ্য দুর্গগুলো। উসমান বাইজেন্টাইনদের দিকে সীমানা বৃদ্ধি এবং তার তুর্কি প্রতিবেশীদের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলার কৌশল গ্রহণ করেন। স্ট্যানফোর্ড শর মতে, এসকল বিজয় স্থানীয় বাইজেন্টাইন অভিজাত ব্যক্তিবর্গে‌র বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়, তাদের মধ্যে কিছু যুদ্ধে পরাজিত হন এবং অন্যান্যরা বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে অধীনস্থ করা হয়।

উসমান কেমন মানুষ ছিলেন


এসব বিজয় উসমানীয় লেখকদের পছন্দের বিষয়বস্তু ছিল। এসকল কিংবদন্তি কবিরা তাদের লেখায় উসমানের বিজয়গাঁথা তুলে ধরেছেন, যা পরবর্তী যুগেও টিকে থাকে। তাদের লেখনিতে আমরা ওসমানকে খুঁজে পাই। উসমান ছিলেন ইসলামী নৈতিকতার বিমূর্ত রূপ। তাঁর জীবন ছিলো খুবই অনাড়ম্বর। তিনি ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তিন সকলের সুখ-শান্তি নিয়ে ভাবতেন। তিনি তার দ্বীনদার শ্বশুরকে প্রথমে কাজি ও পরে উজির নিযুক্ত করেন। উসমান রাজ্যময় মসজিদ নির্মাণ করে নামাজ আদায় ও ইসলামী জ্ঞানচর্চার সুব্যবস্থা করেন। তিনি সৈনিক হিসেবে ছিলেন বিচক্ষণ ও অসাধারণ। তাঁর রণকৌশল ছিলো অত্যন্ত উন্নত মানের। যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমতের এক পঞ্চমাংশ রাষ্ট্র-তহবিলে জমা করে বাকি চার ভাগ সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। সাধারণত তিনি কোমলতা অবলম্বন করতেন। কিন্তু প্রয়োজনে তিনি হতেন ইস্পাতের মতো কঠিন।

তাঁর জীবনে বিলাসিতা ছিল না। দুনিয়ার প্রতি আসক্তি ছিল না। তিনি তাঁর উত্তরাধিকারীর জন্যও ধন-রত্ন জমা করে যাননি। কথিত আছে, ইন্তেকালের আগে তিনি তার পুত্র ওরহানকে সম্বোধন করে বলেন, ‘তোমার প্রতি আমার নির্দেশ এই যে কখনো জুলুম ও নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করবে না। বিজিত অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের উদ্যোগ নেবে। জ্ঞানী ব্যক্তিদের সম্মান করবে। শরিয়াহর বিধি-বিধান মেনে চলবে। ঐশী আইনই আমাদের বড় শক্তি। পরম করুণাময়ের পথেই আমাদের সমৃদ্ধি। প্রজাদের রক্ষণাবেক্ষণ তোমার বড় কর্তব্য। এই কর্তব্য পালন করতে পারলে পরম করুণাময়ের অনুগ্রহ ও আশ্রয় লাভ করতে পারবে।’

কায়ি গোষ্ঠী থেকে উসমানি সাম্রাজ্য


বর্তমান তুরস্কের আনাতোলিয়ার ছোট একটি এলাকা থেকে এই রাজত্বের শুরু হয়, পরবর্তীতে তা লাখ লাখ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ছয়শ বছর ধরে তৈরি হওয়া সাম্রাজ্যের পতন হয় আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগে। 'উসমান'স ড্রিম' বইয়ে ক্যারোলিন ফিঙ্কেল লিখেছেন, বাইজেন্টাইন সীমান্তের কাছাকাছি তার গোত্র বসবাস করলেও, উসমানের কথা জানা যায় ১৩০১ সালে যখন তিনি প্রথম বাইজেন্টাইন একটি বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। ওই যুদ্ধক্ষেত্র বাইজেন্টাইন রাজধানী কনস্টান্টিনোপল থেকে দূরে ছিল না। এরপর থেকে তিনি ও তার উত্তরসূরিরা ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকায় বহু দেশ দখল করেন। এই সাম্রাজ্যের আওতায় ছিল আজকের তুরস্ক, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া, গ্রীস, আলবেনিয়া, মিশর, মেসিডোনিয়া, রোমানিয়া, জর্ডান, প্যালেস্টাইন, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন, সৌদি আরবের কিছু অংশ এবং উত্তর আফ্রিকার উপকূলের বড় একটি অংশ। পরবর্তী ছয়শ বছর উসমানী সাম্রাজ্য টিকে ছিল। উসমান ১৩২৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ৭০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর পর তার সন্তান ওরহান ১৩২৬ থেকে ১৩৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উসমানি সাম্রাজ্যের শাসক বা সুলতান ছিলেন। উসমানী সাম্রাজ্যের সর্বশেষ তথা ৩৭তম খলিফা ছিলেন দ্বিতীয় আবদুল মজিদ। ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ খেলাফত বিলুপ্ত করা হলে তিনি দেশত্যাগ করেন।