ঢাকা | বঙ্গাব্দ

পরিচারকদের নির্যাতন, হিন্দুজা পরিবারের কারাদণ্ড

গৃহসহায়কদের বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে গত সপ্তাহেই তাদের মামলা তুলে নিতে বাধ্য করান হিন্দুজা পরিবার। পরে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করে সুইস পুলিশ।
  • | ২২ জুন, ২০২৪
পরিচারকদের নির্যাতন, হিন্দুজা পরিবারের কারাদণ্ড সাজা ঘোষণার সময়ে তারা কেউই আদালতে ছিলেন না

তারা ভারত থেকে সামান্য বেতনে লোক নিয়ে এসে তাদের প্রাসাদোপম বাড়িতে গৃহ পরিচারকের কাজ করাতেন। পরিণত করেছেন কার্যত ক্রীতদাসে! শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করে দৈনিক ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম। অথচ বেতন সামান্য। একটু ‘ত্রুটিবিচ্যুতি’ ঘটলেই চলত অকথ্য নির্যাতন, হতে হত অত্যাচারের শিকার। এমনই অভিযোগে ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দুজা পরিবারের চার সদস্যকে সাজা শোনাল জেনেভার আদালত। চার থেকে সাড়ে চার বছরের সাজা শোনানো হয়েছে অভিযুক্তদের।

সেই অপরাধে এ বার অনাবাসী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ধনকুবের পরিবার হিন্দুজাদের চার সদস্যকে জেলের সাজা দিল সুইজারল্যান্ডের একটি আদালত। বর্তমানে সুইস নাগরিক হিন্দুজা পরিবারের দণ্ডিত সদস্যরারা হলেন প্রকাশ হিন্দুজা, তার স্ত্রী কমল, ছেলে ও পুত্রবধূ। এদের মধ্যে প্রকাশ ও তার স্ত্রীকে সাড়ে চার বছর এবং তাদের পুত্র-পুত্রবধূকে শোনানো হয়েছে চার বছরের সাজা। এ সময়ে অর্থাৎ সাজা ঘোষণার সময়ে তারা কেউই আদালতে ছিলেন না। তাদের আইনজীবী জানান, উচ্চ আদালতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন জানানো হবে।

হিন্দুজা পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, জেনেভায় হ্রদের ধারে বিলাসবহুল বিশাল ভিলায় কাজ করার জন্য তারা ভারত থেকে মানব পাচারের মাধ্যমে গৃহসহায়ক, গৃহসহায়িকা এবং পাচক নিয়ে আসেন। সুইস আদালত রায়ে জানিয়েছে, পরিচারক, পরিচারিকা ও পাচকদের প্রত্যেককে অমানবিক পরিশ্রম করানো হত। অন্তত ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হত। অথচ বেতন ছিল সামান্য। কথায় কথায় চলত নির্যাতন। বাড়িতে কোনও ভোজসভা বা আমোদ-প্রমোদ চললে, কাজ করতে হত ভোররাত পর্যন্ত। মিলত না ছুটি। রান্নাঘরের মেঝেতেই চাদর পেতে শুতে হত তাদের।

কোনও ছুটি দেওয়া হত না, এমনকি তাদের প্রাসাদোপম ভিলার বাইরে পা রাখতেই দেওয়া হত না। কেড়ে নেওয়া হত পাসপোর্ট। এক কর্মীর কথায়, কুকুরদের জন্য যা খরচ হত তার চেয়েও কম বেতন দেওয়া হত তাদের। বেতনও দেওয়া হত ভারতীয় মুদ্রায়। সুইস ফ্রাঁ দিয়ে নয়। তাদের মাইনের টাকা সরাসরি, ভারতীয় মুদ্রায়, ভারতের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হত। এবং তাদের যে পারিশ্রমিক দেওয়া হত, তা সুইজারল্যান্ডে এ ধরনের কাজের জন্য যে অর্থ পাওয়া যায়, তার দশ ভাগের এক ভাগও নয়!
 
কার্যতই ক্রীতদাস করে রাখা হয় তাদের। তবে ভারত থেকে পাচারের মাধ্যমেই নিয়ে আসা হয় ওই পরিচারকদের, এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে আদালত। জানিয়েছে, যারা এসেছেন তারা সকলেই পুরো স্বেচ্ছায় অবগত হয়েই এসেছেন।

শুনানির সময় সরকার পক্ষের আইনজীবী আদালকে জানান, হিন্দুজা পরিবারে দৈনিক ১৮ ঘণ্টার কাজ করা পরিচারকদের জন্য দিনপ্রতি বরাদ্দ থাকত ৬.১৯ পাউন্ড। অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রার হিসাবে ৬৫৭.৬৪ রুপি। পুরো বছরের হিসাব করলে দাঁড়ায় ২২৫৯.৩৫ পাউন্ড বা ভারতীয় মুদ্রায় দু’লক্ষ ৪০ হাজার রুপির কিছু বেশি। অথচ পোষা কুকুরের জন্য বছরে ৭৬১৬ পাউন্ড ব্যয় করেন হিন্দুজারা। ভারতীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ আট লক্ষ ন’হাজার ১৪৩ রুপি! অর্থাৎ, এক জন পরিচারকের বাৎসরিক বেতনের প্রায় চার গুণ!

ভারত থেকে যাওয়া ওই পরিচারকদের বেশির ভাগই শুধু হিন্দিভাষী। অন্য বিদেশি ভাষা জানতেন না। তাদের পাসপোর্টও কেড়ে নেওয়া হয় বলে আদালতে জানিয়েছেন সরকারি আইনজীবী। তার কথায়, ‘‘বিদেশে এসে, বাইরের জগতের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয় গিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাতেন তারা।’’ মানব পাচার ছাড়া বাকি সব ক’টি ধারায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন হিন্দুজা পরিবারের চার সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ খারিজ করে দিয়ে আদালত জানিয়েছে, যারা ভারত থেকে এখানে কাজ করতে এসেছিলেন, তারা জেনে-বুঝেই এসেছেন, তাদের কী ধরনের কাজ করতে হবে।

তবে হিন্দুজারা যে সে দেশের মানবাধিকার এবং শ্রমবিষয়ক আইন লঙ্ঘন করেছেন এবং গৃহসহায়কদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করেছেন, তা মেনে নেন বিচারকেরা। প্রকাশ হিন্দুজা ও তার স্ত্রী কমলের সাড়ে চার বছর জেল হয়েছে। প্রকাশের ছেলে অজয় ও পুত্রবধূ নম্রতাকে চার বছর কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। মামলা চালানোর খরচ ও সম্ভাব্য জরিমানা হিসেবে হিন্দুজাদের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই হিরা, চুনি ও প্ল্যাটিনামের নেকলেসসহ প্রচুর অলঙ্কার বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ।

ওই মামলায় পঞ্চম অভিযুক্ত, হিন্দুজা পরিবারের ব্যবসা-সংক্রান্ত ম্যানেজার নজিব নিয়াজর ১৮ মাসের কারাদণ্ডের সাজা কমানো হয়েছে। জেলে না গিয়ে তাকে ১৮ মাস প্রোবেশনে কাটাতে হবে। গৃহসহায়কদের বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে গত সপ্তাহেই তাদের মামলা তুলে নিতে বাধ্য করান হিন্দুজা পরিবার। পরে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করে সুইস পুলিশ। প্রসঙ্গত, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ধনকুবের হিন্দুজাদের সম্পত্তির পরিমাণ ৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৩ লক্ষ ৯৩ হাজার কোটি রুপির সমান।

গত শতকের আটের দশকের শেষে সুইজারল্যান্ডে বসবাস শুরু করে হিন্দুজা পরিবার। তবে বর্তমানে তারা মনাকোতে বসবাস করেন। তথ্যপ্রযুক্তি, সংবাদমাধ্যম, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে রিয়েল এস্টেট নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে রয়েছে তাদের ব্যবসা। ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, হিন্দুজা পরিবারের মোট সম্পদ ২০ বিলিয়ন ডলার।