ঢাকা | বঙ্গাব্দ

ইউনূসের ‘মেগাফোন কূটনীতি’তে ভারত হতাশ!

কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ড. ইউনূস টেলিফোনে কথা বললেও এখন পর্যন্ত কোনো মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়নি।
  • | ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ইউনূসের ‘মেগাফোন কূটনীতি’তে ভারত হতাশ! ড. মুহাম্মদ ইউনূস

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এক মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত অবস্থায় রয়েছে। একদিকে যখন হাসিনার ভারতে থাকার বিষয়টি বাংলাদেশের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকার ভারতকে অবাক করেছে।

বিবিসির আনবারাসান এথিরাজন জানার চেষ্টা করেছেন, এই দুই দেশের সম্পর্ক এখন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে?

শেখ হাসিনাকে ভারতপন্থী হিসেবে দেখা হয় এবং তার ১৫ বছরের শাসনামলে দুই দেশের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার সময়টি ভারতের নিরাপত্তার জন্যও সুবিধাজনক ছিল। কিন্তু বর্তমানে ভারতে তার অবস্থান নেওয়া এবং তিনি সেখানে কতদিন থাকবেন সে বিষয়টি দুই দেশের দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রাখার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলেছে। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ড. ইউনূসের গত সপ্তাহের এক সাক্ষাৎকারে।

ভারতীয় সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়ায় দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, দিল্লিতে থাকার সময় শেখ হাসিনাকে যেন রাজনৈতিক বিবৃতি দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয়। তিনি ওই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার আগ পর্যন্ত ভারত যদি তাকে রাখতে চায়, তাহলে শর্ত হচ্ছে তাকে চুপ থাকতে হবে।’

শেখ হাসিনা দিল্লিতে যাবার পর যে বিবৃতি দেন তা বাংলাদেশে ক্ষোভের সৃষ্টি করে, ড. ইউনূস হয়তো সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন। যদিও এরপর থেকে শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে আর কোনো বিবৃতি দেননি। জুলাই ও আগস্টে বিক্ষোভের সময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শেখ হাসিনাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য এবং তাকে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের ভেতরে দাবি উঠেছে।

ড. ইউনূস সাক্ষাৎকারে আরও বলেছেন, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে একসাথে কাজ করতে হবে। দুই দেশের সম্পর্ক এখন 'নিম্ন পর্যায়ে' আছে বলেও তিনি বর্ণনা করেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে কর্মকর্তারা 'হতাশ' বলে জানা গেছে।

এক ভারতীয় কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে কী ঘটছে সেগুলোর দিকে ভারত নজর রাখছে এবং ঢাকা থেকে সরকার ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কী ধরনের বক্তব্য ও বিবৃতি দিচ্ছে সেগুলোর দিকে ভারত লক্ষ্য রাখছে।’ ইউনূসের এ ধরনের বক্তব্যকে ভারতের সাবেক কূটনীতিকরা 'মেগাফোন কূটনীতি' হিসেবে বর্ণনা করছেন এবং বিষয়টিকে তারা বিস্মিত হয়েছেন। ড. ইউনূস মিডিয়ার মাধ্যমে বিতর্কিত দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করছেন বলেও তারা মনে করেন।

‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে কথা বলার জন্য এবং দুই দেশের সকল উদ্বেগের জায়গাগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য ভারত তাদের প্রস্তুতি থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে,’ বলেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার ভিনা সিক্রি। অবসরপ্রাপ্ত এই কূটনীতিক বলেছেন, এই সমস্যাগুলো নিয়ে শান্তিপূর্ণ আলোচনা করা প্রয়োজন এবং কিসের ভিত্তিতে ড. ইউনূস দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ‘নিম্ন পর্যায়ে’ রয়েছে বলে বর্ণনা করেছেন তা স্পষ্ট নয়।

তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে। ‘ভারতীয় নেতারা কি কোনো মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন না? ড. ইউনূসকে যদি নির্দিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি অবশ্যই তার মতামত প্রকাশ করতে পারেন,’ বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। ‘আপনি যদি সমালোচনা করতে চান তবে যেকোনো বিষয়েই সমালোচনা করতে পারেন,’ বলেন তৌহিদ হোসেন।

কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ড. ইউনূস টেলিফোনে কথা বললেও এখন পর্যন্ত কোনো মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়নি। ভারতে একটি বড় ধরনের ঐকমত্য রয়েছে বলে মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনা যতদিন না অন্য কোনো দেশে প্রবেশের অনুমোদন পাচ্ছেন, ততদিন তিনি ভারতে থাকতে পারবেন। তবে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নবনিযুক্ত প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, বিক্ষোভের সময় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য তারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেহেতু তাকে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রধান আসামি করা হয়েছে, আমরা তাকে আইনিভাবে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করব।’ তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানালেও শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করার সম্ভাবনা কম। ‘তিনি এখানে ভারতের অতিথি হিসেবে অবস্থান করছেন। আমরা যদি আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুর প্রতি মৌলিক সৌজন্যতা না করি, তাহলে ভবিষ্যতে কেন কেউ আমাদের বন্ধু হিসেবে গুরুত্ব সহকারে নেবে?’ বলেছেন রিভা গাঙ্গুলী দাস, যিনি ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন।

ড. ইউনূস তার সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর কাছে না পৌঁছানোর জন্যও দিল্লির সমালোচনা করেন। ‘একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে, সবাই ইসলামপন্থী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ইসলামপন্থী এবং বাকি সবাই ইসলামপন্থী এবং তারা এই দেশকে আফগানিস্তানে পরিণত করবে। বাংলাদেশ শুধু শেখ হাসিনার হাতেই নিরাপদ। ভারত এই ব্যাখ্যাতেই বিমোহিত হয়ে আছে,’ সাক্ষাৎকারে বলেন ড. ইউনূস।

কিন্তু ভারতীয় বিশ্লেষকরা ভিন্ন মত পোষণ করেন। ‘এই বক্তব্যের সাথে একেবারেই একমত নই। বাংলাদেশে আমাদের হাইকমিশনাররা কোনো লেবেল না দিয়েই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলেছেন,’ ভিনা সিক্রি বলেন।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় ঢাকা ও দিল্লির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সেসময় ভারতের উত্তর-পূর্ব থেকে বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ঢাকাকে অভিযুক্ত করে দিল্লি। যদিও বিএনপি সেই অভিযোগ অস্বীকার করে।

তবে বাংলাদেশের অনেকেই উল্লেখ করেছেন, ভারতের উচিত বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করা। সামনে যখনই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক না কেন এই দলটি জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। ‘সরকার পতনের পর থেকে কোনো ভারতীয় কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি। কারণ জানি না,’ বলেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। উল্টো বিএনপির সঙ্গে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ও ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা নিয়মিত বৈঠক করছেন।

বাংলাদেশের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এএফএম খালিদ হোসেন বলেছেন, যারা ধর্মীয় স্থানকে টার্গেট করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, ইসলামি কট্টরপন্থীরা যদি বাংলাদেশে একটি শক্ত অবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে সেটা যত ছোটই হোক না কেন, তা দিল্লির জন্য বিপদের ঘণ্টা বাজিয়ে দেবে।

নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসীম উদ্দীন রাহমানী গত মাসে জামিনে মুক্ত হয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। শেখ হাসিনার সরকার এই গোষ্ঠীটিকে ২০১৬ সালে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করে। ২০১৫ সালে এক নাস্তিক ব্লগারকে হত্যার অভিযোগে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অন্যান্য বিচারাধীন মামলার কারণে কারাগারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও তিনি কারাগারে ছিলেন। ‘গত মাসে বেশ কয়েকজন জঙ্গিকে মুক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ভারত চেনে,’ প্রাক্তন কূটনীতিক রিভা গাঙ্গুলি দাস একে একটি ‘গুরুতর বিষয়’ বলে অভিহিত করেছেন।