ভারতীয় শিল্পবাণিজ্যের মহীরুহ রতন টাটা মারা গেছেন। বার্ধক্যজনিত সমস্যা নিয়ে মুম্বইয়ের একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। বুধবার রাতে সেখানে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
বুধবার রাতে টাটা গ্রুপের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন সাবেক চেয়ারম্যান। সংবাদসংস্থা পিটিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাও নিশ্চিত করেছেন রতন টাটার জীবনাবসান হয়েছে। তার মৃত্যুতে শিল্পমহল তো বটেই, ভারতের সাধারণ মানুষও শোকস্তব্ধ। কারণ কারও কাছে রতন টাটা নেহাত শিল্পপতি বা টাটা গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান নন, একজন ‘আদর্শ’ ব্যক্তি। যিনি কোটি-কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন। কর্পোরেট চাকচিক্য নয়, তাকে একেবারে নিজেদের একজন ভেবে এসেছেন মানুষ। নিজের চোখে না দেখার পরও আদর্শ হয়ে থেকেছেন। আর সেই মানুষটার মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছেন আমজনতাও।
সম্প্রতি জানা যায়, রতন অসুস্থ অবস্থায় মুম্বইয়ের হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সোমবার সেই দাবি উড়িয়ে দেন শিল্পপতি। সমাজিক মাধ্যমে তার অ্যাকাউন্টে একটি বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, নিয়মমাফিক চেকআপের জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তিনি সুস্থ রয়েছেন। এই নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। বিবৃতিতে জানানো হয়, ‘সম্প্রতি আমার স্বাস্থ্য নিয়ে নানা জল্পনা রটেছে। আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই, এ সব খবরই ভুয়া। বিগত কয়েক দিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যার কারণে নিয়মমাফিক চেক-আপের জন্য হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। চিন্তার কোনও কারণ নেই। সুস্থ আছি। জনগণ এবং সংবাদমাধ্যমের কাছে অনুরোধ, ভুয়া খবর ছড়াবেন না।’
১৯৯১ সালে রতন টাটা শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হন। ১০০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের এই প্রতিষ্ঠানের ইস্পাত থেকে সফটওয়্যার পর্যন্ত ব্যবসা রয়েছে। ১০০ বছরের বেশি সময় আগে তার প্রপিতামহ এই শিল্পগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১২ সাল পর্যন্ত রতন টাটা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
রতন টাটা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ১৯৯৬ সালে টাটা টেলিসার্ভিসেস প্রতিষ্ঠা করা হয়। টাটা গ্রুপ ভারতের ব্র্যান্ডিংয়ে অনন্য। আর এই ব্র্যান্ডিংয়ে সবচেয়ে বড় অবদান রতন টাটার। অর্ধশত বছর তিনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন টাটা গ্রুপের জন্য, তিলে তিলে বড় করেছেন গ্রুপকে। ১৬০ বছরের পুরোনো এ প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের ১০০টি দেশের সঙ্গে ব্যবসা করে। এই প্রতিষ্ঠানটির ২১ বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন রতন টাটা। এ সময়ে টাটা গ্রুপের আয় বেড়েছে ৪০ গুণ। আর মুনাফা বেড়েছে ৫০ গুণ। মধ্যবিত্তকে চার চাকার স্বপ্ন দেখান রতন টাটাই। পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা গড়ে ওঠে। যদিও রাজনৈতিক টানাপড়েনে পরে গুজরাতে কারখানা সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়।
৭৫ বছর বয়সে ২০১২ সালে টাটা গ্রুপের নির্বাহী ক্ষমতা ছেড়ে দেন রতন টাটা। সেই জায়গায় পারিবারিক আত্মীয় সাইরাস মিস্ত্রিকে আনা হয়। কিন্তু ২০১৬ সালে সাইরাসকে টাটা সন্সের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ফের অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্বে ফেরেন রতন টাটা। এরপর ২০১৭ সালে নটরাজন চন্দ্রশেখরণকে অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সমাজসেবামূলক কাজে আরও বেশি করে যুক্ত হন রতন টাটা।
২০০০ সালে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান রতন টাটা। ২০০৮ সালে পান ‘পদ্ম বিভূষণ সম্মান’। মহারাষ্ট্র, আসাম সরকারও তাকে সম্মান প্রদান করে। ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স, আইআইটি বম্বে, ইয়েল ইউনিভার্সিটি, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, রাজা তৃতীয় চার্লস থেকেও বিশেষভাবে সম্মানিত হন।
রতন টাটা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি। তবে ২০১১ সালে একটি সাক্ষাৎকারে জীবনে প্রেম এসেছে বলে স্বীকার করে নেন। চার-চারবার বিয়ের পিঁড়িতে বসার উপক্রম হলেও শেষ পর্যন্ত কোনো সম্পর্ক পরিণতি পায়নি বলে জানান।
নরেন্দ্র মোদির শোক
রতন টাটার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। বুধবার রাতে রতন টাটার সঙ্গে কয়েকটি ছবি পোস্ট করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শ্রী রতন টাটাজি একজন দূরদর্শী শিল্পপতি ছিলেন। তার মন মমতায় পরিপূর্ণ ছিল। মানুষ হিসেবে অসাধারণ। উনি ভারতের অন্যতম পুরনো এবং অন্যতম সেরা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রদান করেন। তবে শুধু সেই কাজের জন্য নয়, রতন টাটার নামটা যে স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা থাকবে তার মানবিকতার কারণে, সেটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মোদি। তিনি বলেন, ‘একইসঙ্গে উনি স্রেফ বোর্ডরুমের মধ্যে আটকে থাকেননি। সেই গণ্ডি ছাড়িয়ে যান তিনি। নিজের নম্রতা, উদারতা এবং আমাদের সমাজকে উন্নততর করে তোলার জন্য যে ব্রত নেন, সেটার কারণে উনি অসংখ্য মানুষের প্রিয় হয়ে উঠেন।’
মমতার শোক
রতন টাটার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘টাটা সনসের চেয়ারম্যান এমেরিটাস রতন টাটার মৃত্যুতে আমি শোকস্তব্ধ। ভারতীয় শিল্পের ক্ষেত্রে একজন অগ্রণী নেতা। যিনি মানুষের জন্য নিজের জীবন নিবেদন করে দিয়েছেন। তার প্রয়াণে ভারতীয় শিল্পজগত এবং সমাজে অপূরণীয় ক্ষতি হল।’