ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং নরেন্দ্র মোদির সম্পর্ক শুরু হয়েছিল বন্ধুত্বপূর্ণভাবে, কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু বিষয়ে মতবিরোধও দেখা দিয়েছে। ট্রাম্প ভারতের নীতির সমালোচনা করেছেন, বিশেষ করে বাণিজ্য ও শুল্ক ইস্যুতে, তবে মোদিও তাকে নিজের বন্ধু হিসেবে অভিহিত করেছেন। ২০১৯ সালে একাধিক অনুষ্ঠানে তারা একে অপরকে সমর্থন জানালেও, তাদের সম্পর্কের ভিত অনেকটা স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি ভারতের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি মোদির পক্ষে সুবিধাজনকও হতে পারে।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে, যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন শহরে ‘হাউডি মোদি’ অনুষ্ঠানে মোদি ও ট্রাম্প একসঙ্গে ভাষণ দেন, যেখানে প্রায় ৫০ হাজার ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে মোদি স্লোগান দেন, ‘আবকি বার ট্রাম্প সরকার,’ যা ট্রাম্পের প্রতি তার সমর্থন এবং বন্ধুত্বের প্রকাশ ছিল। পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালে গুজরাটের আহমেদাবাদে অনুষ্ঠিত ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে ট্রাম্প উপস্থিত ছিলেন, যা তাদের সম্পর্কের আরেকটি উদাহরণ।
তবে, ট্রাম্প ও মোদির বন্ধুত্বের মাঝে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যদিও তারা একে অপরকে বন্ধু বলেই পরিচয় দেন, তবে ট্রাম্প ভারতের কিছু নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বহুবার অভিযোগ করেছেন যে ভারত মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে, কিন্তু নিজেদের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করার সময় তারা শুল্কমুক্ত সুবিধা চায়। এর মধ্যে বিশেষভাবে তিনি ভারতের তথ্য প্রযুক্তি, ওষুধ এবং পোশাক খাতের ওপর আরোপিত শুল্কের কথা উল্লেখ করেছেন।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ট্রাম্প ভারতকে ‘সমস্যাযুক্ত’ দেশ বলে অভিহিত করেন, বিশেষ করে বাণিজ্য নিয়ে তার অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন, ‘ভারত খুবই সমস্যা-জনক দেশ। ব্রাজিলও সেরকমই।’ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির জন্য ভারতকে আরেকটি বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে তুলে ধরেছেন, বিশেষত সেখানে ব্যবসা করতে গেলে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের বিষয়টি। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আওতায় তিনি ভারতের প্রতি বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে কঠোর অবস্থান নিতে চান। এর মাধ্যমে তিনি ভারতের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন।
এদিকে, ট্রাম্প ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করতে চান, তবে বাণিজ্য এবং অভিবাসন সংক্রান্ত সমস্যাগুলো নিয়ে তার অবস্থান কঠোর। বিশেষত ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, যেখানে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে বেশি রফতানি করে এবং কম পণ্য আমদানি করে। ট্রাম্প চাচ্ছেন যে ভারত তার পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করার মতো সিদ্ধান্ত নিলে, যুক্তরাষ্ট্রও ভারতের পণ্যের ওপর একই ধরনের শুল্ক আরোপ করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন— মোদি ও ট্রাম্পের বন্ধুত্বের ভিত্তি পারস্পরিক স্বার্থের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তবে স্বার্থের সংঘাত হলে সম্পর্কের গভীরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিবাল মন্তব্য করেছেন, ‘বন্ধুত্ব মূলত স্বার্থের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু যখন স্বার্থের সংঘাত ঘটে, তখন বন্ধুত্বের প্রকৃতি কতটা গভীর তা বুঝা যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত বাণিজ্যের কথা বলে যখন তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। তবে চীনকে নিয়ে তাদের সমস্যা ভারতের সঙ্গে নয়।’
মোদি ও ট্রাম্পের সম্পর্কের মধ্যে কিছু বিষয় এমনও রয়েছে, যেখানে ট্রাম্পের নীতির কারণে মোদির লাভ হতে পারে। যেমন, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে ট্রাম্পের অবস্থান। মোদি সরকারকে ট্রাম্প কখনোই মানবাধিকার বা গণতন্ত্র নিয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না, যা বাইডেন প্রশাসন করত। তবে, মার্কিন কংগ্রেসের ওপর ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণ সীমিত, আর সেখান থেকেই ভারতের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে।
২০১৯ সালে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যখন ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন, তখন ট্রাম্প কাশ্মীর নিয়ে মধ্যস্থতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি দাবি করেন, মোদি তাকে কাশ্মীর বিষয়ে মধ্যস্থতা করার জন্য বলেছেন। তবে, ভারত সরকারের তরফ থেকে দ্রুত এটি খারিজ করা হয় এবং কড়া ভাষায় বলা হয়, মোদি এমন কোনো অনুরোধ করেননি। ভারতীয় সরকারের অবস্থান, কাশ্মীর নিয়ে তারা কোনো মধ্যস্থতা মেনে নেবে না। এতে ভারতের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্কের মধ্যে কিছু অস্বস্তি তৈরি হয়।
এদিকে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে রাশিয়া এবং চীন আরও কাছাকাছি আসছে, যা ভারতের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। বিশেষজ্ঞ ব্রহ্মা চেলানি বলছেন, ‘রাশিয়া নয়, আসল হুমকি হলো চীন, যা ট্রাম্প প্রশাসনকে মনোযোগ দিতে হবে।’ তিনি দাবি করেন, চীন তার শক্তি বাড়িয়ে চলেছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বের শক্তি কাঠামোতে নতুন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।
শেষ পর্যন্ত, ট্রাম্প ও মোদির বন্ধুত্ব কীভাবে পরবর্তী সময়ে বিকশিত হবে এবং বাস্তব সমস্যাগুলির সমাধান করতে কতটা কার্যকর হবে, তা এখনই বলা কঠিন। তবে এটি স্পষ্ট যে, এই বন্ধুত্ব অনেকটা রাজনৈতিক স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল, এবং এটি একদিকে যেমন একাধিক সুযোগ তৈরি করতে পারে, তেমনি অন্যদিকে কিছু চ্যালেঞ্জও সামনে আনতে পারে।