যে ভাগ্যের জোরে একরাতে হয়েছেন কোটিপতি, সেই ভাগ্যের হাতেই পর্যদুস্ত হন লরা গ্রিফিথ। ব্রিটেনের ইস্ট ইয়র্কশায়ারের বাসিন্দা লরা লটারিতে জিতে যান প্রায় দুই মিলিয়ন প্রাউন্ড। এতো টাকা জিতেও প্রায় নিঃস্ব লরা। একে একে হারিয়ে ফেলেন সমস্ত সম্পদ, স্বামীকেও।
লটারি জেতার আগে ইস্ট ইয়র্কশায়ারে সাদামাঠা জীবনযাপন করতেন লরা ও তার স্বামী রজার। বছর তিরিশের এই দম্পতি দুই কন্যাসন্তানকে নিয়ে থাকতেন একটি ছোট বাড়িতে। প্রাচুর্য না থাকলেও সুখের অভাব ছিল না গ্রিফিথ দম্পতির সংসারে। লরা ছিলেন পারফর্মিং আর্টের শিক্ষিকা, রজার একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার ম্যানেজার। বিশ্ববিদালয়ে পরিচয়ের পর ১৯৯৭ সালে রজারকে বিয়ে করেন লরা।
এই সুখী পরিবারের চিত্রটা হঠাৎ করে বদলাতে শুরু করে ২০০৫ সালে লটারি জেতার পর থেকে। যদিও রাত আড়াইটায় আসা ফোনটিকে প্র্যাঙ্ক হিসেবেই ভেবে নেন ২২ মাসের কন্যা সন্তানের মা লরা। কিন্তু পরদিন যখন আবারও ফোন আসে, তখন নিজেরে ভাগ্যকেও বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি। কিন্তু এক সঙ্গে ২০ লাখ পাউন্ড হাতে পাওয়ার পরই তাদের জীবনের গতি সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে বাঁক নেয়। একসঙ্গে এত টাকা হাতে আসার পরই মাথা ঘুরে যায় তাদের। বিলাসবহুল জীবনের দিকে দ্রুত আকৃষ্ট হন লরা ও রজার। আচমকা লটারি জিতে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই চাকরি ছেড়ে দেন।
তারপরই নিজেদের পুরনো বাড়ি ছেড়ে নতুন আস্তানার সন্ধান করতে থাকেন। সাড়ে চার লাখ পাউন্ড দিয়ে বাড়ি কেনেন দু’জনে। সেই শখ পূর্ণ হওয়ার পর দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর দিকে মন দেন। দুবাই, ফ্লোরিডা, ফ্রান্স কোনওটাও বাদ দেননি এই দম্পতি। সব বিদেশভ্রমণ ছিল বিলাসিতায় মোড়া। সেখানেও লাখ লাখ পাউন্ড খরচ করেন তারা। চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন লরা ও রজার।
দেড় লাখ পাউন্ড দিয়ে একটি স্যালোঁ কেনেন লরা। এ ছাড়া একাধিক দামি ও বিলাসবহুল গাড়িও ছিল এই দম্পতির গ্যারাজে। দামি ব্র্যান্ডের ব্যাগের প্রতি লরার ঝোঁক ছিল। সেই শখ মেটাতেও মোটা টাকা ব্যয় করেন তিনি। আর্থিক অবস্থা ফিরতেই দুই মেয়েকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করেন লরা ও রজার। রজার মোটা বেতনের চাকরি ছেড়ে ছেলেবেলার শখ পূরণ করতে উঠেপড়ে লেগে যান। তার স্বপ্ন ছিল রক গায়ক হওয়ার। এ ছাড়া নিয়মিত আয়ের বন্দোবস্ত করতে লটারিতে পাওয়া টাকা স্টক মার্কেটেও বিনিয়োগ করে দেন। কিন্তু এই সুদিন স্থায়ী হয়নি। পরপর কয়েকটি দুর্ঘটনার ফলে কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন লরা।
২০১০ সালে তাদের স্বপ্নের বাড়ি আগুনে পুড়ে যায়। লরা বলেন, কাজে ছিলাম, কিন্তু রজার, দুই মেয়ে এবং পোষ্য কয়েকটি কুকুর তখন বাড়িতেই। ওরা কোনও রকমে বের হলেও কিছুই রক্ষা করা যায়নি। তিনদিন আগুন জ্বলেছে। পরনের কাপড়ও ছিল না। কোনোমতে সেই বাড়ি সারিয়ে এক বছর পর আবার ওই বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন তারা। পরিস্থিতি সামলে ওঠার আগেই আরও একটি ধাক্কা নেমে আসে লরার জীবনে। রজারের একটি গোপন ইমেল লরার চোখে পড়ায় তাদের দাম্পত্যে ফাটল ধরে। একপর্যায়ে ২০১৩ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। স্ত্রী ও সন্তানদের ছেড়ে নিজের মা-বাবার কাছে ফিরে আসেন রজার। সেই সময় রজারের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল মাত্র ৭৫ পাউন্ড।
সংবাদমাধ্যমের কাছে রজার স্বীকার করেছেন, নিজেদের দোষেই তারা সব হারিয়েছেন। সম্পদের অপব্যবহার করে ফেলেছেন, এমন স্বীকারোক্তিই উঠে এসেছিল রজারের গলায়। লরাও সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলে বলেন, কেউ যখন পরিশ্রম না করে বিপুল টাকার মালিক হয়ে যান, তখন তার দুঃসময়ে কেউ পাশে এসে দাঁড়ায় না। লটারিতে অর্থলাভের আগে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক কেমন ছিল তা বলতে গিয়ে লরা জানান, রজার ও তাঁর মধ্যে খুবই কম মতপার্থক্য ঘটত। রজার অনলাইনে সপ্তাহে মাত্র ২ পাউন্ডের বাজি ধরতেন। লরাও স্বীকার করেছেন, এই পরিমাণ অর্থ হাতে পাওয়ার পর তাদের ধারণা ছিল না কীভাবে এর সদ্ব্যবহার করতে হয়।
২০১৩ সালের পর থেকে লরার জীবন সম্পূর্ণ বদলে যেতে থাকে। দুই সন্তানের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে। তখন থেকেই লরার লড়াইয়ের শুরু। বিচ্ছেদের পর তাঁর আর্থিক সমস্যা আরও বড় হয়ে দেখা দেয়। বাড়ি, স্যালোঁ সব বিক্রি করে দিতে হয়। একটি সুখী পরিবারের ভাঙন ও বিপর্যয়ের প্রভাব পড়ে লরার সন্তানদের ওপর। নিজেদের বাড়িতে আগুন লাগার ঘটনায় মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে লরার বড় মেয়ে। বাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা মনে করলে এখনও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সে। লরাও ক্রোহন ডিজিজে আক্রান্ত ওজন হারান প্রায় ৪০ কেজি। সব হারিয়ে এখন দুই মেয়েকে নিয়ে নিজের মায়ের সঙ্গে একটি সাধারণ বাড়িতে থাকেন লরা।
বড় মেয়ে রুবির এখন বয়স ২০। আর কিটির বয়স ১৭। লটারি জেতার পরেই ছোট মেয়ের জন্ম হয়। লরা বর্তমানে একজন পেশাদার রূপটান ও ট্যাঁটু শিল্পী। লটারি জয়ের টাকা নষ্ট নিয়ে তার আর কোনও অনুশোচনা নেই। তবে বুদ্ধির প্রয়োগ সঠিক হলে জীবনের গল্পটা অন্য রকম হতে পারত বলে মনে করেন তিনি। লরার মুখে হাসি এখনও ফুরায়নি। বলেছেন, জীবনকে এখনও ভালোবাসি, যা পেয়েও হারিয়েছি, তা নিয়ে কোনও দুঃখবোধ নেই। এত পরিমাণ অর্থ হারিয়ে ফেলেছি এ নিয়েও দুঃখ নেই, হয়তো আবার কেওন একদিন সব হবে।