কলকাতার চিকিৎসকরা যখন আন্দোলনে বসেন সেই সময় তাঁদের অন্যতম মূল দাবি ছিল আর একটিও যেন তিলোত্তমার ঘটনা না ঘটে। সেই দাবি কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল তা আরও একবার প্রমাণ করল এই ঘটনা। যে আরজি করে তিলোত্তমাকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ উঠে, সেই হাসপাতালের পিকুতে ভর্তি সাত মাসের এক শিশু। তাকে ‘যৌন হেনস্থা’ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে।
ঘটনাটি ঘটেছে বড়তলা থানার অন্তর্গত বিডন স্ট্রিটে। শিশুর পরিবারের অভিযোগ, শুক্রবার মধ্যরাতে ফুটপাথবাসী মা-বাবার কাছে ঘুমোচ্ছিল সে। তাদের কাছ থেকেই তুলে নিয়ে গিয়ে যৌন নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ। শিশুর গোপনাঙ্গে রয়েছে ক্ষতচিহ্ন। বর্তমানে স্থিতিশীল অবস্থায় আরজি করে পিকুতে চিকিৎসাধীন দুধের শিশুটি। তার চিকিৎসার জন্য বসানো হয়েছে মেডিক্যাল বোর্ড।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের অ্যাডিশনাল মেডিক্যাল সুপার দ্বৈপায়ন বিশ্বাস বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যা জানতে পেরেছি তাতে শিশুটি পেডিয়াট্রিক আইসিইউ-তে ভর্তি রয়েছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে না। বাচ্চাটাকে খেতে দেওয়া হয়েছে। মেডিক্যাল বোর্ড তৈরি হয়েছে। তারাই ঠিক করবেন পরবর্তী চিকিৎসা কী হবে। শুনেছি যখন শিশুটিকে আনা হয় সেই সময় গোপনাঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।’
শিশুকে যৌন হেনস্থা করবে বলে রীতিমতো ‘টার্গেট’ করে অভিযুক্ত। তার জন্য শিশুটিকে অপহরণের আগে এক-দু’বার নয়, মোট নয়বার ঘটনাস্থলে ঘুরে গেছে সে। আশপাশে কোথায় কোথায় সিসি ক্যামেরা রয়েছে, তা-ও দেখে নেয়। এর পরে শুক্রবার রাতে বড়তলা থানা এলাকার ফুটপাতে বাবা-মায়ের পাশে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত শিশুটিকে তুলে নিয়ে গিয়ে যৌন নির্যাতন চালায় সে। ঘটনার তদন্তে নেমে বুধবার রাতে ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুর থানা এলাকার আলমপুর থেকে সেই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে কলকাতা পুলিশ। তাকে জেরা করে এমনই তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা।
লালবাজার জানিয়েছে, ধৃতের নাম রাজীব ঘোষ ওরফে গোবরা। সে আদতে ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুরের বাসিন্দা। শ্যামবাজারের কাছে দিনমজুরের কাজ করত। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তাকে চিহ্নিত করা হয়। বৃহস্পতিবার রাজীবকে আদালতে তোলা হয়। তাকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা নগর দায়রা আদালতের বিশেষ পকসো কোর্টের বিচারক ইন্দ্রিলা মুখোপাধ্যায় মিত্র।
রাজীবের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, অপহরণ এবং পকসো আইনের ছয় নম্বর ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। এ দিন ধৃতের ডিএনএ পরীক্ষা, রক্ত পরীক্ষা, শনাক্তকরণ প্যারেড এবং মেডিকো-লিগ্যাল পরীক্ষার আর্জি জানান সরকারি আইনজীবী। আদালত তা মঞ্জুর করেছে। পুলিশ সূত্রের খবর, রাজীবের মা অঞ্জলি ঘোষের দাবি, ‘বাবা মারা যাওয়ার পরে রোজগারের জন্য কলকাতায় গিয়েছিল ছেলে। কী ভাবে কী ঘটেছে, কিছুই জানি না।’
এ দিন বিচার ভবনের মুখ্য সরকারি আইনজীবী দীপঙ্কর কুণ্ডু এবং বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি সৈকত পাণ্ডে জানান, ভারতীয় ন্যায় সংহিতার নতুন আইন অনুযায়ী, অভিযুক্তকে জেল হেফাজতে নিয়ে শনাক্তকরণ প্যারেড, মেডিকো-লিগ্যাল পরীক্ষা করানো সুবিধাজনক। প্রয়োজনে পরে তাকে ফের পুলিশি হেফাজতে পাঠানোর আবেদন করা যেতে পারে। সেই কারণে রাজীবকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেল হেফাজতে পাঠানোর আর্জি জানানো হয়। আপাতত নির্যাতিতা শিশুটির চিকিৎসা চলছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
এদিকে লালবাজার সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার দুপুরে বড়তলা থানা এলাকার এক বাসিন্দা নিজের বাড়ির সামনের ফুটপাতে সাত মাসের ওই শিশুটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। শিশুটির গোপনাঙ্গ-সহ শরীরের একাধিক জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। ওই বাসিন্দাই প্রথমে বড়তলা থানায় খবর দেন। পুলিশ এসে শিশুটিকে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করার পাশাপাশি তার পরিবারের খোঁজ শুরু করে।
শিশুটির উপরে যে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে, সে ব্যাপারে এক প্রকার নিশ্চিত ছিলেন তদন্তকারী অফিসারেরা। তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, বড়তলা থানা এলাকাতেই ফুটপাতে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে সে। শুক্রবার রাতে শিশুটি উধাও হয়ে যায়। পরে শনিবার তাকে পাওয়া যায়। তদন্তে নেমে শিশুটি যেখানে থাকে এবং যেখান থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়, দুই জায়গারই আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ খতিয়ে দেখে পুলিশ। কারণ, ঠিক ওই দুই ঘটনাস্থলে কোনও সিসি ক্যামেরা নেই। তবে, আশপাশের সিসি ক্যামেরায় সন্দেহজনক ভাবে রাজীবকে বেশ কয়েক বার ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। সেই সূত্র ধরে তার খোঁজ শুরু করে পুলিশ।
এক তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, ‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজে যাতে কোনও ভাবেই ধরা না পড়ে, তা নিশ্চিত করতেই ঘটনাস্থলে একাধিক বার ঘুরে যায় অভিযুক্ত। ঘুমন্ত শিশুটিকে তুলে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
এসজেড