ঢাকা | বঙ্গাব্দ

রক্তাক্ত সিরিয়া, ‘হট কেটে’ ছুরি চালাবে কারা?

সিরিয়ার বাশার-আল-আসাদ সরকারের পতনে দামেস্ক বিদ্রোহীদের দখলে যাওয়ায় ‘লাভের গুড়’ খেতে পারে ইসরায়েল এবং তুরস্ক।
  • | ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৪
রক্তাক্ত সিরিয়া, ‘হট কেটে’ ছুরি চালাবে কারা? রক্তাক্ত সিরিয়া।

এ যেন মার্কিন হাতে রাশিয়ার পরাজয়! পশ্চিম এশিয়ার রণাঙ্গনে প্রতিটা চাল যেন পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের মর্জিমাফিক। আপাতত সেখান থেকে ‘ল্যাজ গুটিয়ে’ পালানো ছাড়া মস্কোর সামনে দ্বিতীয় রাস্তা খোলা নেই। ইরানের অবস্থাও তথৈবচ। অন্য দিকে, এই পরিস্থিতিতে ‘লাভের গুড়’ কতটা খাওয়া যায়, তার হিসাব এরই মধ্যে শুরু করেছে ওয়াশিংটন।


সিরিয়ায় বাশার-আল-আসাদ সরকারের পতনকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাদের দাবি, বিদ্রোহীদের দামেস্কে ঢুকে পড়া আসলে যুক্তরাষ্ট্রেরই জিত। এ বার অতি সহজেই ‘হট কেকে ছুরি চালানোর’ মতো করে পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে ‘রাজত্ব’ করতে পারবে ওয়াশিংটন।


শুধু তাই নয়, আসাদ সরকারের পতনে সিরিয়া থেকে রুশ সেনাছাউনি সরাতে বাধ্য হবে মস্কো। এত দিন ভূমধ্যসাগরের তীরে ছিল সেগুলির অবস্থান। কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সিরিয়ার রুশ সেনা ঘাঁটিগুলিকে সমঝে চলছিল যুক্তরাষ্ট্রের নৌসেনাও। দামেস্কের দখল বিদ্রোহীদের হাতে যাওয়ায় সে দিক থেকেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যুক্তরাষ্ট্র।


তবে পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে বিদ্রোহীরা ক্ষমতায় আসায় সবচেয়ে প্যাঁচে পড়েছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের ‘পয়লা নম্বর দুশমন’ এই শিয়া মুলুকটি এত দিন সিরিয়াকে বাফার রাষ্ট্র হিসাবে ব্যবহার করছিল। দামেস্কের মাটির উপর দিয়েই লেবাননের হিজবুল্লাহর কাছে পৌঁছচ্ছিল তেহরানের উন্নত ও সেরা হাতিয়ার। এই সব অস্ত্রের জোরে প্রায়ই শিয়াপন্থী এই সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসরায়েলে আক্রমণ চালিয়ে গেছে। তেহরানের হাতিয়ার আসা বন্ধ হলে সেই পরিকল্পনা থেকে পিছু হটতে হবে তাদের।


আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, সিরিয়ার সঙ্কটে পোয়া বারো হতে পারে ইসরায়েল এবং তুরস্কের। দুই রাষ্ট্রর কাছেই পশ্চিম এশিয়ার দেশটির বেশ কিছুটা জমি হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এতে এক দিকে যেমন ‘গ্রেটার ইহুদিভূমি’ তৈরির স্বপ্নপূরণের দিকে এক কদম এগোবে তেল আবিব, অন্য দিকে তেমনই আরবে আধিপত্য বাড়বে আঙ্কারার।


প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা আবার দামেস্ক পতনকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন। এর মাধ্যমে আরব দুনিয়া থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হলেন তিনি। এর ফলে আগামী দিনে পশ্চিম এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব ওয়াশিংটন কয়েক গুণ বাড়িয়ে নিতে পারবে, তা বলাই বাহুল্য।


২০১১ সালে প্রথম বার সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে মদত দেওয়া শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে ‘আইএস’ জঙ্গিদের বাড়বাড়ন্ত রুখতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো একাধিক বার হামলাও চালিয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে সঙ্কট মেটাতে ক্রমাগত সিরিয়া বিভাজনের জিকির তুলে গেছে আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’।


কিন্তু এত চেষ্টা সত্ত্বেও রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকায় আসাদ সরকারের পতন ছিল একরকম অসম্ভব। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’-এর সূচনা করে মস্কো। আর ঠিক তখনই পশ্চিম এশিয়া থেকে পূর্ব ইউরোপের ‘বাদামি ভালুক’কে তাড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে।


যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিরক্ষা কার্যালয় পেন্টাগনের পদস্থ জেনারেলরা বুঝে নেন হাতিয়ার সরবরাহ চালু রাখলে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে ইউক্রেন দখল খুব সহজ হবে না। এই সুযোগে ন্যাটোভুক্ত দেশ তুরস্ককে দলে টেনে আসাদ-বিরোধী বিদ্রোহীদের পিছন থেকে মদত জুগিয়ে গেলে কেল্লাফতে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।


সমর বিশেষজ্ঞদের কথায়, আসাদ সরকারের কফিনে দ্বিতীয় পেরেকটি পুঁতেছে ইরান ও হিজবুল্লাহ। তিনমুখি যুদ্ধের মাঝেই ইহুদি গুপ্তচরেরা বুঝে যান হিজবুল্লাহকে হাতিয়ার সরবরাহ করতে সিরিয়াকে ব্যবহার করছে ইরান। অবিলম্বে তা বন্ধ করার হুমকি দিয়ে প্রেসিডেন্ট আসাদকে সতর্ক করে তেল আবিব। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় সেখানে বিমান হামলা চালায় আইডিএফ।


ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের ঝটিকা আক্রমণে বড়সড় লোকসান হয় সিরিয়ার সরকারি সেনাবাহিনীর। তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রথমে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পোকে নিশানা করেন বিদ্রোহীরা। ৫ ডিসেম্বর তাদের হাতে পতন হয় সামরিক দিক থেকে আরেও একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হামার। এর পর রাজধানী দামেস্কে ঢুকে পড়ে বিদ্রোহী সেনার দল।


সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দামেস্ক বিদ্রোহীদের দখলে আসতেই দেশ ছেড়েছেন প্রেসিডেন্ট আসাদ। সিরিয়ার সেনাকর্তারা জানিয়েছেন, বিমানে উঠেছেন তিনি। তবে আসাদ কোথায় গেছেন, তা জানা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তিনি প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোহম্মদ গাজি জালালি।


১৩ বছর ধরে চলা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যে সমস্ত স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের দাবি, এই অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারেন আসাদ। ঠিক যেমনটা ২০১৩ ও ২০১৭ সালে করেছেন তিনি।


মার্কিন গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, দেশে ছেড়ে না পালিয়ে গুপ্ত রাসায়নিক অস্ত্রভান্ডারে আশ্রয় নিয়েছেন আসাদ। হাল না ছেড়ে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শেষ অবলম্বন হিসাবে এ বার ওই হাতিয়ার ব্যবহার করবেন তিনি। ২০১৩ সালে তার নির্দেশে হওয়া কুখ্যাত ঘৌটা রাসায়নিক হামলায় প্রাণ হারান তিন শতাধিক সাধারণ নাগরিক। ২০১৭ সালের খান শেখুন রাসায়নিক আক্রমণ ছিল আরও মারাত্মক। ওই ঘটনায় নিহত কয়েকশো নিরিহ সিরিয়ান নাগরিকদের একটা বড় অংশই ছিল শিশু। দু’টি ঘটনাতেই রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের প্রমাণ মিলেছে বলে স্পষ্ট করে জাতিসংঘ।


দ্বিতীয়ত, জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি কুর্সিতে বসার পর ওয়াশিংটনের সিরিয়া নীতিতে বড় বদল দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যেই সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলেছেন ট্রাম্প। আর তাতে স্বস্তি পেয়েছে মস্কো।যুক্তরাষ্ট্রের হবু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ‘সিরিয়ার পরিস্থিতি খুব প্যাঁচানো। কিন্তু ওরা আমাদের বন্ধু নয়। এই গৃহযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু করার নেই। এটা আমাদের লড়াই নয়। ওখানে যা হচ্ছে, হোক। আমরা এর মধ্যে নাক গলাব না।’


অন্য দিকে, রাশিয়া ও ইরান— দু’টি দেশের তরফেই পাশে থাকার আশ্বাস পেয়েছেন ‘পলাতক’ প্রেসিডেন্ট আসাদ। বিদ্রোহীদের থেকে আলেপ্পো পুনর্দখল করতে সেখানে বিমানহানা চালিয়েছে মস্কো। পাশাপাশি দামেস্কের পতন বাঁচাতে ‘শিয়া মিলিশিয়া’ পাঠিয়েছে ইরান।


২০০০ সালের জুলাইয়ে হাফেজ় আল আসাদের মৃত্যুর পর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন তার পুত্র বাশার। দেশটির কম্যান্ডার-ইন-চিফও তিনি। প্রথম থেকেই তার মাথার উপরে রয়েছে রাশিয়ার হাত। ২০১৫ সালে আলেপ্পো হাতছাড়া হলে মস্কোর কাছে সাহায্য চান তিনি। এর পর রুশ বিমানহানাকে সম্বল করে ২০১৬ সালে আলেপ্পো পুনর্দখল করেন বাশার।


গোয়েন্দা সূত্রে খবর, সিরিয়ার বিদ্রোহী দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’ (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী ‘জইশ আল-ইজ্জা’র সঙ্গে কুখ্যাত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আল কায়দার’ দহরম মহরম রয়েছে। ফলে লম্বা সময় ধরে ওয়াশিংটনের পক্ষে তাদের সমর্থন করে যাওয়া এক রকম অসম্ভব। রাশিয়া সেই সুযোগ কাজে লাগালে পশ্চিম এশিয়ার মাটি যে ফের রক্তে ভিজবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।


সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, আল জাজিরা


এসজেড