ইরানি নারীরা সরকারি পোশাকবিধি না মানলে এ বার মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বিধান রেখে চলতি সপ্তাহে নতুন আইন চালু করেছে ইরান। নতুন আইনে মহিলাদের পোশাকবিধি না-মানার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কেউ ‘অশোভন পোশাক’ কিংবা ‘নগ্নতা’-কে তুলে ধরছেন বলে মনে করা হলে সাড়ে ১২ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত আর্থিক জরিমানা হতে পারে। বার বার একই ‘অন্যায়’ করলে পাঁচ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। যদি কোনও মহিলার অপরাধকে ‘পৃথিবীর প্রতি অনাচার’ বলে মনে করে প্রশাসন, তা হলে ইরানের ইসলামীয় দণ্ডবিধি অনুসারে তার মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
নতুন আইন অনুসারে, যারা এই পোশাকবিধি লঙ্ঘনকে সমর্থন করবে, তাদের উপরেও নেমে আসবে শাস্তির খাঁড়া। কোনও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, স্কুল, সংবাদমাধ্যম এমনকি কোনও ট্যাক্সিচালকও মহিলাদের ‘অশোভন’ পোশাকে দেখলে তা সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনকে জানাতে হবে। না হলে সেটিকেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হবে।
ইরানের কট্টর হিজাব আইন নিয়ে অতীতে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে আন্তর্জাতিক মঞ্চে। সম্প্রতি এর প্রতিবাদে তেহরানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী প্রকাশ্যে অন্তর্বাস পরে হেঁটেছেন। তাকে আটকের পর প্রশাসন জানায়, তিনি মানসিক ভাবে অসুস্থ। পরে তাকে একটি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ঘটনার পর পরই ইরানের নারী ও পরিবারকল্যাণ দপ্তর জানায়, হিজাব পরতে অনিচ্ছুক মহিলাদের জন্য বিশেষ ‘ক্লিনিক’ চালু করা হয়েছে। সেখানে ‘চিকিৎসা’ করা হবে হিজাব পরতে অনিচ্ছুক মহিলাদের। ইরানে যে ধরনের কড়া পোশাকবিধি কার্যকর রয়েছে মহিলাদের জন্য, তাতে ওই ‘ক্লিনিক’ তৈরির অভিপ্রায় নিয়ে আবার প্রশ্ন ওঠে। সেগুলি আদৌ কোনও চিকিৎসাকেন্দ্র, নাকি ক্লিনিকের নামে ‘জেলখানা’— তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে।
ইরানে দীর্ঘ দিন মহিলাদের জন্য কড়া পোশাকবিধি রয়েছে। আবশ্যিক ভাবে মাথা ঢেকে রাখতে হয় হিজাবে। এ ছাড়া রাস্তায় বার হলে ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হয় তাদের। নিয়ম না-মানলে কড়া শাস্তির নির্দেশও রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই কড়াকড়ি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ হয়েছে এই ফতোয়ার বিরুদ্ধে। তবে ইরানের প্রশাসন তা কড়া হাতে দমন করেছে এবং শাস্তি আরও কড়া করেছে।
ইরানে হিজাব-বিরোধী প্রতিবাদের ক্ষেত্রে ২০২২ সালে মাহ্সা আমিনির প্রসঙ্গ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ২০২২ সালে হিজাব না-পরার ‘অপরাধে’ মাহ্সাকে তুলে নিয়ে যায় ইরানের নীতি পুলিশ। পুলিশ হেফাজতে ‘অসুস্থ হয়ে পড়া’ মাহ্সা মারা যান হাসপাতালে। প্রতিবাদে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মঞ্চ তো বটেই, ইরানের মহিলারাও সরব হন। রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখান ইরানি মহিলারা। পোশাক ফতোয়া উড়িয়ে, চুল কেটে প্রতিবাদে শামিল হন তারা। সেই প্রতিবাদ কড়া হাতে দমন করে ইরান-প্রশাসন।
তারপর হিজাব আইন আরও কড়া হয়েছে। আগে হিজাব আইন ভাঙলে ১০ দিন থেকে দু’মাস পর্যন্ত জেল-সহ আর্থিক জরিমানা হত। মাহ্সাকাণ্ড এবং তার পরবর্তী প্রতিবাদের পর, সেই মেয়াদ বৃদ্ধি করে ৫ থেকে ১০ বছর কারাদণ্ডের বিল পাশ হয় ইরানে। সঙ্গে ছিল আর্থিক জরিমানাও। এ বার সেই তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণীর ঘটনার পর পোশাকবিধি সংক্রান্ত আইন আরও কড়া করল ইরান।
ইরানের নতুন আইন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ইরানি মহিলারা বিদেশি সংবাদমাধ্যমে নিজেদের মুখ দেখালে, বা অন্য কোনও ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ’ চালালে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে অ্যামনেস্টি। মানবাধিকার সংগঠনের পশ্চিম এশিয়ার সহকারি অধিকর্তা ডায়ানা এল্টাহাওয়ে ইরানের এই আইনকে ‘ন্যক্কারজনক’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, নারীস্বাধীনতা এবং তার অধিকারকে খর্ব করতে এই আইন চালু করা হয়েছে।
সূত্র: রয়টার্স
এসজেড