বিশ্ব ইজতেমা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় সম্মেলন নয়, এটি ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রমের অন্যতম বৃহৎ সমাবেশ। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত মুসল্লিরা এখানে একত্রিত হয়ে দ্বীনের শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ইসলামের মূল আদর্শকে জীবনে বাস্তবায়নের সংকল্প করেন। আলেম-ওলামারা বিশ্ব ইজতেমার তাৎপর্য ও গুরুত্ব নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মতামত প্রদান করেছেন।
বিশ্ব ইজতেমার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
বিশিষ্ট আলেমগণ মনে করেন, বিশ্ব ইজতেমা শুধুমাত্র নামাজ-রোজার আলোচনা নয়, বরং এটি একটি বিশেষ ইসলাহি (সংশোধনমূলক) প্ল্যাটফর্ম, যেখানে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধির পথ দেখানো হয়। ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা সাদ কান্ধলভী বলেন, “বিশ্ব ইজতেমা একটি ব্যতিক্রমধর্মী দ্বীনি আয়োজন, যেখানে শুধু ওয়াজ-নসিহত হয় না, বরং ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামের সঠিক শিক্ষা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তা নিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।”
মাওলানা জুবায়ের আহমদ মনে করেন, “বিশ্ব ইজতেমা হলো এমন এক মিলনমেলা, যেখানে সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও ইসলামের শান্তির বার্তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এখানে আসা মুসল্লিরা শুধু দোয়া-দরুদেই সীমাবদ্ধ থাকেন না, বরং তারা দ্বীনের দাওয়াতের শিক্ষা নিয়ে নিজ নিজ অঞ্চলে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দেন।”
তাবলিগ জামাতের দাওয়াতি কার্যক্রম ও ইজতেমার ভূমিকা
বিশ্ব ইজতেমা মূলত তাবলিগ জামাতের উদ্যোগে আয়োজিত হয়। তাবলিগ জামাতের প্রবক্তারা মনে করেন, ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা মুসলমানদের কাছে সহজভাবে পৌঁছানোর অন্যতম কার্যকর মাধ্যম হলো এই ইজতেমা। পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা তারিক জামিল বলেন, “ইজতেমার মাধ্যমে হাজারো মানুষ ইসলামের সৌন্দর্য সম্পর্কে জানতে পারেন এবং নিজেদের জীবনে আমল করার প্রেরণা পান।”
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম মুফতি কাজী ইবরাহীম বলেন, “আজকের মুসলিম সমাজ নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিশ্ব ইজতেমার মতো উদ্যোগগুলো মুসলমানদের ঈমানি শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এবং তাদের আত্মশুদ্ধির পথ দেখায়।”
বিশ্ব ইজতেমার সামাজিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাব
বিশ্ব ইজতেমা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন। প্রতিবারের মতো এবারও ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের মুসল্লিরা এতে অংশগ্রহণ করেছেন।
মিশরের প্রসিদ্ধ ইসলামিক গবেষক ড. ইউসুফ আল কারদাবি বলেছিলেন, “বিশ্ব ইজতেমার মতো আয়োজন ইসলামের ঐক্যের প্রতীক। এখানে ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা দেশের কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে ইসলামের পথে চলার প্রতিজ্ঞা করেন।”
বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ আলেম মাওলানা আশরাফ আলী বলেন, “বিশ্ব ইজতেমা মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে এসে মুসলমানরা একত্রিত হয়ে দোয়া করেন, কুরআন ও হাদিসের আলোকে নিজেদের জীবন গঠনের শিক্ষা নেন, যা পরবর্তীতে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।”
আখেরি মোনাজাত ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনা
প্রতি বছর বিশ্ব ইজতেমার শেষ দিনে আখেরি মোনাজাতে লাখো মুসল্লি আল্লাহর কাছে নিজেদের গুনাহ মাফের প্রার্থনা করেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি কামনা করেন। মুফতি মেনক বলেন, “বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি একটি বৃহৎ আত্মশুদ্ধির মাধ্যম। এই মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহর জন্য রহমত ও বরকত কামনা করা হয়।”
বাংলাদেশের মুফতি ফজলুল হক আমিনী বলেছিলেন, “বিশ্ব ইজতেমা ইসলামের শান্তির বার্তা প্রচারের এক অনন্য মাধ্যম। এখানে আসা প্রতিটি মানুষ দ্বীনের পথে চলার নতুন অনুপ্রেরণা নিয়ে ফিরে যান, যা সমাজের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।”
আলেম-ওলামাদের মতে, বিশ্ব ইজতেমা শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনি আয়োজন। এটি মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, ঈমানি শক্তি বৃদ্ধি এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আলেমদের ভাষায়, “বিশ্ব ইজতেমা আমাদের জীবনের এক নতুন পরিবর্তনের দ্বার উন্মোচন করে, যেখানে আমরা দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর পথে ফিরে আসার অনুপ্রেরণা পাই।”
thebgbd.com/NA