স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি ও লংগদু উপজেলার মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা রয়ে গেছে অপূর্ণ। মাত্র ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ না হওয়ায় এখনও জেলা সদর রাঙ্গামাটির সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি এই দুই উপজেলার সঙ্গে। ফলে প্রায় দুই লাখ মানুষ বছরের পর বছর ধরে সীমাহীন দুর্ভোগ ও অবহেলার মধ্যে বসবাস করছেন।
১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর থেকেই রাঙ্গামাটিতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলায় আজও নেই সরাসরি সড়ক যোগাযোগ। বিদ্যুৎ, ব্রিজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ হলেও এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলার বাসিন্দারা এখনও সড়ক সংযোগ থেকে বঞ্চিত।
বর্তমানে এই দুই উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। তবে বর্ষা মৌসুমে নাব্যতা থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে লেক শুকিয়ে যাওয়ায় নৌচলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিকল্প হিসেবে খাগড়াছড়ি হয়ে ১৪০ কিলোমিটারেরও বেশি ঘুরপথে যাতায়াত করতে হয়। এতে সময় ও খরচ দুটিই বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি।
জেলা সদর থেকে নানিয়ারচরের বড়পুল হয়ে লংগদু পর্যন্ত প্রস্তাবিত সড়কটির দৈর্ঘ্য মাত্র ২৪ কিলোমিটার। এ সড়কটি নির্মিত হলে লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলাবাসী সরাসরি রাঙ্গামাটি জেলা সদরের সঙ্গে সড়কপথে যুক্ত হবে। এতে করে যোগাযোগ সময় নেমে আসবে দুই ঘণ্টায়। পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পর্যটনের পথও সুগম হবে।
বর্তমানে লংগদু থেকে জেলা সদরে পৌঁছাতে নৌপথে পাড়ি দিতে হয় প্রায় ৮০ কিলোমিটার পথ। এতে সময় লাগে তিন থেকে চার ঘণ্টা। অপরদিকে, বাঘাইছড়ি থেকে ১৪৪ কিলোমিটার নৌপথে যাত্রায় সময় লাগে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত। শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গেলে এই নৌপথ অনেক সময় বন্ধ হয়ে যায়। তখন একমাত্র বিকল্প পথ খাগড়াছড়ি হয়ে যাতায়াত, যার জন্য পাড়ি দিতে হয় প্রায় দেড়শ কিলোমিটার।
পর্যটননির্ভর সাজেক ভ্যালিতে বর্তমানে রাঙ্গামাটি থেকে সরাসরি যাতায়াত করা সম্ভব নয়। পর্যটকদের যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়ে ৮ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রা শেষে সাজেকে। অথচ এই ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মিত হলে সাজেকে পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র সাড়ে ৪ ঘণ্টা। এতে করে রাঙ্গামাটি হয়ে সাজেকে একটি নতুন পর্যটন রুট তৈরি হবে, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে নতুন মাত্রা দেবে।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য মিনহাজ মুরশীদ বলেন, এই সড়কটি নির্মাণ হলে শুধু যোগাযোগ সুবিধা নয়, বরং কৃষি, পর্যটন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাতেও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। বিশেষ করে কৃষিপণ্য পরিবহন সহজ ও সাশ্রয়ী হবে। লংগদু ও বাঘাইছড়ির মানুষকে আর অবহেলার শিকার হতে হবে না।
২০২০ সালে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন (ইসিবি) চেঙ্গী নদীর ওপর ৫০০ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করে, যার মাধ্যমে নানিয়ারচর উপজেলা সরাসরি জেলা সদরের সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু নানিয়ারচর থেকে লংগদু পর্যন্ত সংযোগ সড়কটি নির্মাণ না হওয়ায় এই সেতুর পূর্ণ সুফল পাচ্ছে না বাঘাইছড়ি ও লংগদু উপজেলার মানুষ।
লংগদুর মনীষা তঞ্চঙ্গ্যা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, রাঙ্গামাটিতে কলেজে ভর্তি হয়েছি, কিন্তু প্রতিবার যেতে হলে নৌকা কিংবা খাগড়াছড়ি হয়ে ঘুরপথে যাওয়া লাগে। সময় লাগে দুই দিন। সরাসরি সড়ক থাকলে এত কষ্ট হতো না। সবার মতো আমরাও আধুনিক যোগাযোগ চাই।
বাঘাইছড়ির ব্যবসায়ী রাজেন্দ্র লাল চাকমা বলেন, এত বছর ধরে শুনছি সড়ক হবে, উন্নয়ন হবে। কিন্তু এখনও সেই কাঙ্ক্ষিত সড়কটা আসলো না। সরকার যদি চায়, এই ২৪ কিলোমিটার সড়ক এক বছরেই হতে পারে। আমাদের দাবি, এবার যেন কথায় নয়, কাজে দেখায়।
রিনা মারমা নামে লংগদুর এক সমাজকর্মী বলেন, আমরা চাইলেই রাঙ্গামাটি শহরের সুযোগ-সুবিধা নিতে পারি না, কারণ যাতায়াতটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক থাকলে নারীরা চিকিৎসা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগে সহজে পৌঁছাতে পারবে। এটা আমাদের অধিকার।
লংগদু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিক্রম চাকমা বলেন, আমাদের উপজেলায় একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নৌপথ। শুষ্ক মৌসুমে যখন পানির স্তর কমে যায়, তখন চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন মানুষকে পায়ে হেঁটে বা খাগড়াছড়ি হয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। এই সড়ক হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক সহজ হবে এবং কৃষিপণ্যের দামও পাবেন কৃষক।
এই অঞ্চলের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে কৃষি নির্ভর জনগোষ্ঠী। কিন্তু সড়ক না থাকায় কৃষিপণ্য পরিবহনে গুণতে হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি খরচ। এতে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা। সবজি, ফলমূল ও পানসহ বিভিন্ন পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হলেও সময়মতো বাজারজাত করতে না পারায় অনেক সময় পচে যায় বা লোকসান গুনতে হয়।
বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল কাইয়ুম বলেন, নানিয়ারচরের বড়পুল থেকে লংগদু পর্যন্ত সড়ক হলে আমরা দ্রুত রাঙ্গামাটিতে যেতে পারবো। কৃষিপণ্য পরিবহণ সহজ হবে। এমনকি ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারেও আমরা সরবরাহ করতে পারবো। এতে আমাদের আর্থিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে।
রাঙ্গামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্যমতে, নানিয়ারচর-লংগদু সড়কের মোট প্রস্তাবিত দৈর্ঘ্য ৩৭ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে বগাছড়ি থেকে নানিয়ারচর পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৮২ কিলোমিটার অংশে বিটুমিনাস সড়ক ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে। অবশিষ্ট ২৩ দশমিক ৭০ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ হলে পুরো রুটটি কার্যকর হবে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, আমরা ইতোমধ্যে এই সড়ক নির্মাণের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। সরেজমিন পরিদর্শনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় নকশা ও ব্যয় পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে পরবর্তী কার্যক্রম দ্রুত শুরু করা হবে।
সামাজিক সংগঠকরা বলছেন, বিগত পাঁচ দশক ধরে অবহেলিত থাকা এই অঞ্চলের মানুষ আর অপেক্ষা করতে চায় না। তারা উন্নয়নের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। সড়ক একটি জনগোষ্ঠীর জন্য কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং তা উন্নয়নের প্রবেশদ্বার।
thebgbd.com/NIT