ঢাকা | বঙ্গাব্দ

ন্যায়বিচার চান তাতারি

তাতারির বয়স এখন ৭০। ১৯৮১ সালে তাকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হলে তিনিও মুক্তি পান।
  • অনলাইন ডেস্ক | ০৬ জুন, ২০২৫
ন্যায়বিচার চান তাতারি রাঘিদ তাতারি

রাঘিদ তাতারি। পেশায় একজন তরুণ পাইলট। বয়স মাত্র ২৬। উড়োজাহাজ চালাতে জানতেন, কিন্তু সময়ের রাজনৈতিক ঝড় তাকে টেনে নিয়ে গেল নির্জন এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, যেখানে আকাশ নেই, মুক্তি নেই, বাতাসও নেই, আছে শুধু মৃত্যুর অপেক্ষা।


রাঘিদ তাতারি, সিরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় কারাবন্দি থাকা ব্যক্তি। ৪৩ বছরের সেই বন্দিজীবনে তিনি হারিয়েছেন পরিবার, বন্ধুবান্ধব, এমনকি সময়ের বোধও। বার্লিন প্রাচীর ভাঙার মতো ঐতিহাসিক ঘটনা কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মতো বিশাল পরিবর্তনের খবরও তাঁর কানে পৌঁছাতে সময় লেগেছে বহু বছর। এখন তিনি মুক্ত, কিন্তু স্মৃতির আগুনে পুড়ছেন এখনও। তবে তিনি প্রতিশোধ চান না, চান জবাবদিহিতা। চান যেন আর কোনও মানুষ আইনের বাইরে এই নিষ্ঠুরতার শিকার না হন।


তাতারির বয়স এখন ৭০। ১৯৮১ সালে তাকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ৮ ডিসেম্বর, ইসলামপন্থীদের নেতৃত্বে পরিচালিত এক সশস্ত্র অভিযানে দীর্ঘদিনের শাসক বাশার আল-আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর বহু রাজনৈতিক বন্দির সঙ্গে তিনিও মুক্তি পান।


রাঘিদ তাতারি জীবিত বের হতে পারলেও, সিরিয়ার হাজারো পরিবার এখনও খুঁজে ফিরছে তাদের নিখোঁজ স্বজনদের। যারা দেশটির ভয়ংকর সব কারাগারের ভেতর থেকে একরকম গায়েব হয়ে গেছেন। দামেস্কে নিজের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে এএফপি’কে তাতারি বলেন, ‘ভয়াবহ নির্যাতনে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।’


সামরিক আদালত তাকে ‘বিদেশি শক্তির সঙ্গে যোগসাজশ’ করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে আজীবন কারাদণ্ড দেন। যদিও তিনি বরাবরই তা অস্বীকার করেছেন। প্রথমে হাফেজ আল-আসাদের আমলে এবং পরে তার ছেলে বাশারের সময় একের পর এক কারাগারে স্থানান্তর করা হয় তাতারিকে।


নিজের পাইলট ইউনিফর্ম পরা পুরোনো ছবি দেখিয়ে তাতারি বলেন, ‘প্রতিশোধ চাই না। তবে যারা অন্যায় করেছে, তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত হতেই হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা চাই না কেউ যেন সঠিক প্রক্রিয়া ছাড়া কারাবন্দি হয়।’


সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের তথ্যমতে, আসাদ পরিবারের শাসনামলে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ কারাবন্দি হন। তাদের অর্ধেকই ২০১১ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলনের পর আটক হন। সংস্থাটি জানায়, এসব বন্দির মধ্যে প্রায় ২ লাখ হেফাজতেই মৃত্যুবরণ করেছেন।


সর্বাধিক সময় বন্দি থাকা ব্যক্তি


‘সাইদনায়া কারাগারের বন্দি ও নিখোঁজদের সংগঠন’ এর সহ প্রতিষ্ঠাতা দেয়াব সেররিয়া জানান তাতারি শুধু সিরিয়ারই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় বন্দি থাকা রাজনৈতিক কয়েদি। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের উপকণ্ঠে অবস্থিত কুখ্যাত সাইদনায়া কারাগারকে ‘মানব কসাইখানা’ হিসেবে অভিহিত করেছে। তাতারিও একসময় সেখানে বন্দি ছিলেন। তার ভাষায়, সিরিয়ার মরুভূমিতে অবস্থিত পালমিরা কারাগারে কাটানো ১৫ বছর সবচেয়ে ভয়াবহ।


‘আমরা মৃত্যুকেই কামনা করতাম’


তাতারি বলেন, ‘পালমিরা এমন এক স্থান, যেখানে কোনো নিয়ম নেই, মানবতা নেই, আইন নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেখানে বন্দিরা নির্যাতনের ভয় পেত না, তারা বরং মৃত্যুকেই কামনা করত।’ তাতারির ভাষায়, ‘পালমিরায় নির্যাতনের যেসব বিবরণ দেওয়া হয়, তা বাস্তবের তুলনায় নগণ্য। একজন প্রহরী যদি কোনো বন্দিকে অপছন্দ করত, তবে তাকে মেরে ফেলতে পারত। আমাদের জোর করে বলানো হতো, ‘হাফিজ আল-আসাদই তোমার ঈশ্বর’, আমি তা বলিনি।’


উল্লেখ্য, ১৯৮০ সালে পালমিরা কারাগারে ইসলামপন্থী বন্দিদের ওপর ভয়াবহ গণহত্যা চালানো হয়। সেসময় হাফিজ আল-আসাদের বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ হত্যা প্রচেষ্টার জেরে বন্দিদের গুলি করে হত্যা করা হয় বা কক্ষে ঢুকিয়ে খুন করা হয়।


তাতারি বলেন, তিনি এতটাই বিচ্ছিন্ন ছিলেন, বার্লিন প্রাচীর ভাঙা বা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের খবরও পেয়েছেন অনেক পরে একজন বন্দির মাধ্যমে। ওই ব্যক্তি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর কারাগারে আসেন।


২০১১ সালের গণবিক্ষোভ শুরুর পর তাকে দক্ষিণ সিরিয়ার সুইদা কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে কিছু বন্দির কাছে মোবাইল ফোন ছিল, যা তারা গোপনে ব্যবহার করত। ‘মোবাইল ফোন মানেই মুক্তির স্বাদ, এটাই যেনো আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখত,’ বলেন তাতারি। তিনি আরো জানান, তিনি নিজের ফোনটি কক্ষে খোঁড়া গর্তে লুকিয়ে রাখতেন। একপর্যায়ে ধরা পড়লে তাকে তারতুসের একটি কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। মুক্তির আগ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন।


পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন


তাতারি ছিলেন সিরীয় সেনাবাহিনীর সেইসব কর্মকর্তাদের একজন, যারা ১৯৭৬ সালে লেবাননে সিরিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ এবং ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে মুসলিম ব্রাদারহুড দমন অভিযানকে সমর্থন করেননি। তিনি জানান, আমাদের অনেকেই সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক দমনযজ্ঞের বিরোধী ছিলাম। ১৯৮০ সালে তার দুই সহপাঠী জর্ডানে পালিয়ে যান। এরপর মিশর হয়ে জর্ডানে পৌঁছান তাতারি। তবে পরিবারকে নিরাপদ রাখতে পরবর্তীতে তিনি সিরিয়ায় ফিরে যান। এরপরই গ্রেপ্তার হন।


তাতারির স্ত্রীর গর্ভে তখন ছিলো তাদের প্রথম সন্তান। দীর্ঘদিন পরিবারটি ধরে নেয় তিনি মারা গেছেন। ১৯৯৭ সালে ঘুষ দিয়ে প্রথমবারের মতো ছেলের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পান। সেসময় ছেলের বয়স ছিল ১৬। ‘খুব নার্ভাস ছিলাম, মাত্র ১৫ মিনিট পরেই দেখা শেষ করি,’ কান্না বিজড়িত কণ্ঠে জানান তাতারি। তার স্ত্রী পরে মারা যান। আর ছেলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, কারণ সরকারবিরোধী আন্দোলনের শুরুতেই হুমকি পান তিনি।


কারাগারে থাকার সময় তাতারি মানসিকভাবে টিকে থাকতে ছবি আঁকাআঁকি করতেন। আবার কখনো কখনো কল্পনার জগতে ডুবে থাকার চেষ্টা করতেন। তিনি বলেন, ‘স্বপ্নেও ভাবিনি, এক রাতে আসাদ শাসন ভেঙে পড়বে। এটা সত্যিই অকল্পনীয়।’


সূত্র: এএফপি


এ্সজেড