ঢাকা | বঙ্গাব্দ

বন উজাড় ঠেকাচ্ছে গ্রামবাসী

সিয়েরা লিওন বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে বিশ্বের ১৯১টি দেশের মধ্যে ১১তম স্থানে।
  • অনলাইন ডেস্ক | ১২ জুন, ২০২৫
বন উজাড় ঠেকাচ্ছে গ্রামবাসী চারকোলই অনেকের রান্নার একমাত্র ভরসা।

সিয়েরা লিওনের একটি জাতীয় উদ্যানে, গহীন অরণ্যের ভেতর, সাত সন্তানের জননী এক নারী কয়লা তৈরির জন্য একগাদা গাছের গুঁড়ি জ্বালাতে যাচ্ছিলেন। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত এই কয়লা উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি সস্তা হলেও অবৈধ—বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনে প্রবলভাবে ঝুঁকিপূর্ণ দেশটির সংরক্ষিত রেইনফরেস্ট এলাকায়। কিন্তু বিধবা আমিনাতা সানকোহ জানিয়েছেন, জীবিকা নির্বাহের আর কোনো উপায় না থাকায় তিনি এই পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন।


স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী দল বন সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকলেও সানকোহ তাদের হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে বলেন, ‘গাছ তো আবার লাগানো হবে, তাহলে সমস্যা কোথায়?’ তাকে পাল্টা সাবধান করে গ্রুপনেতা সিজার সেনেসি বলেন, ‘আপনি ভাবছেন, বন উজাড়ের প্রভাব আপনাদের ওপর পড়বে না। কিন্তু ভবিষ্যতে আপনার প্রপৌত্ররাও এর ফল ভোগ করবে।’


ফ্রিটাউন থকে এএফপি জানায়, পশ্চিমাঞ্চলীয় পেনিনসুলা ন্যাশনাল পার্কের এই উষ্ণ ও আর্দ্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অরণ্যটি দেশটির প্রাথমিক বনের অবশিষ্টাংশের অন্যতম। ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত এর এক-তৃতীয়াংশ বা প্রায় ৫,৬০০ হেক্টর বনভূমি হারিয়ে গেছে বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।


জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্য অনুসারে, কেবল গত বছরেই প্রায় ৭১৫ হেক্টর বন উজাড় হয়েছে, যা প্রায় ১,৩৩০টি ফুটবল মাঠের সমান। ইউনেস্কোর হিসাবে, এই অঞ্চলটিতেই সিয়েরা লিওনের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ জীববৈচিত্র্য রয়েছে। তবে বিদ্যুৎ সংকট ও জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে চারকোলই অনেকের রান্নার একমাত্র ভরসা।


-বাঁচার লড়াই -


সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলে গোপন কয়লা উৎপাদন কেন্দ্রগুলো খুঁজে পেতে রাস্তা ও পাহাড়ি পথ পেরিয়ে অনেক দূর পায়ে হেঁটে যেতে হয়। এএফপি দল সেখানকার এমন এক জায়গায় পৌঁছায়। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস গরমে গাছের গুঁড়ি সাজিয়ে পাথর দিয়ে চাপা দিয়ে কয়লা তৈরি করছিলেন একদল শ্রমিক। পাশে সানকোহ কাঠের বিশাল স্তূপ জ্বালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।


বয়স ৪৫, স্বামী মারা গেছেন চার বছর আগে। সন্তানদের খাওয়ানো ও লেখাপড়ার খরচ চালাতে আগে তিনি নির্মাণ সাইটে পাথর ভাঙার কাজ করতেন। ‘পাথর ভাঙা খুব কষ্টকর ছিল। তাই এখন কয়লা তৈরি করছি,’ বলেন তিনি। বন সংরক্ষণে সরকারি ব্যর্থতা ও ভূমি দখলের হুমকি মোকাবেলায় স্থানীয় জনগণকে নিয়েই তৈরি হয়েছে ৪০ জনের স্বেচ্ছাসেবী দল। ‘রাতে আগুন লাগলেও আমরা সাড়া দিই,’ বলেন দলের নেতা সেনেসি। ‘এই বন বাঁচাতে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।’


সরকার, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ও এনজিও ‘এনভায়রনমেন্টাল ফাউন্ডেশন ফর আফ্রিকা’ (ইএফএ)-র সহায়তায় এই প্রকল্প চালু হয়েছে। ইএফএ’র নির্বাহী পরিচালক টমি গারনেট বলেন, ‘মানুষ এসব অপরাধ করে, কারণ তারা জানে শাস্তি পাবে না।’ দারিদ্র্য, অজ্ঞতা ও লোভ—এই তিন কারণে বন উজাড় হচ্ছে বলে জানান ৩০ বছর ধরে বন সংরক্ষণে কাজ করা গারনেট।


সিয়েরা লিওন বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে বিশ্বের ১৯১টি দেশের মধ্যে ১১তম স্থানে।


-‘অতীব জরুরি পর্যায়ে’ -


সরকারি বন রেঞ্জারদের সীমিত সামর্থ্য ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় স্থানীয়দের মাধ্যমেই সমাধান খুঁজছেন পরিবেশবাদীরা। গারনেট জানান, প্রতিদিন টহল ও তথ্য সংগ্রহের জন্য স্থানীয়দের মাসিক ৬০ ডলার করে দেওয়া হচ্ছে। এতে সরকারি টহলের চেয়ে অনেক বেশি তথ্য মিলছে।


ইএফএ গত এক বছরে ১,০৩,০০০ গাছ রোপণ করেছে। ২০২৮ সালের মধ্যে আরও পাঁচ লাখ গাছ লাগানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। অন্যদিকে, ‘মাইল ১৩’ নামে পরিচিত এলাকার আরেক দল কর্মী কাজ করছে সুলাইমান বারির নেতৃত্বে। ‘এই আগুন, এই ধ্বংস—এমন সিয়েরা লিওন আমরা আগে দেখিনি, 'বলেন আবেগাপ্লুত বারি। ‘আমরা এখন এমন এক সংরক্ষিত এলাকায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে বহু প্রাণীর বাস। এই বন আমাদেরই রক্ষা করতে হবে।’


সরকারও বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান ভূমি ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের জরিপ বিভাগের পরিচালক তাম্বা ডাউডা। তবে এনজিও ‘গ্রিন সিনারি’র প্রতিষ্ঠাতা জোসেফ রহাল হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘আমরা এখন আর জরুরি নয়, অতীব জরুরি স্তরে পৌঁছে গেছি। এখনই পদক্ষেপ না নিলে আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে এই বন আর থাকবে না।’


সূত্র: এএফপি


এসজেড