ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোট গণনা চলছে। ১৯ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪৪ দিন ধরে ৭ দফায় যে ৬৪ কোটিরও বেশি ভোটার ভোট দিয়েছেন, সেই ভোটের চুড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে আজ।
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত বিজেপি নেতৃত্বধীন রাজনৈতিক জোট ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জোট ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্সের (আইএনডিআইএ) মধ্যে। ভারতের ২৮টি রাজ্য ও ৮ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সবগুলোতেই হয়েছে ভোটগ্রহণ। তবে দেশটির রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের ফলাফল বা জয়-পরাজয় নির্ধারণ করবে মূলত কয়েকটি রাজ্যের ফলাফল। এই রাজ্যগুলো হলো—
পশ্চিমবঙ্গ
ভারতের এই গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যটিতে লোকসভা আসন রয়েছে ৪২টি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩৪টিতেই জয়ী হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৯ সালের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পায় ২২টি আসন। বাকি ১৯টি আসনে বিজেপি এবং একটি আসনে জয়ী হয় কংগ্রেস। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিগত নির্বাচনের মতো এবারও
তার দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং রাজনৈতিক জোট ‘ইনডিয়া’র ব্যাপরে ব্যাপকভাবে
আশাবাদী।
লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এই এগিয়ে যাওয়া অবশ্য ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলটির জন্য খুব সহায়ক হয়নি। তবে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপির প্রধান সুকান্ত মজুমদারের দৃঢ় বিশ্বাস— এবার বিগত দুই লোকসভা নির্বাচনের চেয়েও রাজ্যে আসন বেশি পাবে বিজেপি। বুথফেরত জরিপ বলেছে, রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে ২৬টিতে জয়ী হয়েছে বিজেপি।
তবে গত ১০ বছরে রাজ্যে যত নির্বাচন হয়েছে, প্রত্যেকটিতেই ভূমিধস জয়ের ঘোষণা দিয়েছিল বিজেপি; কিন্তু ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা গেছে, একের পর এক প্রার্থীর হেরে যাওয়ার কারণে লক্ষ্যের ধারে কাছেও যেতে পারেনি দলটি।
এবারের নির্বাচনেও সম্ভবত তেমনই ঘটতে যাচ্ছে, অর্থাৎ অতীতের পুনরাবৃত্তি। নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক ফলাফলে জানা গেছে, রাজ্যের ৪২টি সংসদীয় আসনের ৩১টিতেই জিততে যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস, ১০টিতে বিজেপি এবং একটিতে কংগ্রেস।
মহারাষ্ট্র
৫ বছরে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় এই রাজ্যটিতে যে ব্যাপক রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে, তা অন্য কোনো রাজ্যে দেখা যায়নি। এই রাজ্যে লোকসভার আসন রয়েছে ৪৮টি। ২০১৯ সালের নির্বাচনে মহারাষ্ট্রের শীর্ষ রাজনৈতিক দল শিব সেনা ও বিজেপির মধ্যে জোট ছিল। সেই নির্বাচনে ৪৮টি আসনের মধ্যে ৪১টিতে জয়ী হয় এই জোট।
তবে ২০২২ সালে শিব সেনায় মধ্যে ফাটল ধরে এবং দলটি দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়। একাংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন একনাথ শিন্ডে এবং অপরাংশের নেতৃত্বে রয়েছেন মহারাষ্ট্রের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বাল ঠাকরের ছেলে উদ্ভব ঠাকরে। একনাথ শিন্ডের নেতৃত্বাধীন শিব সেনা বিজেপি জোটে রয়েছে, আর উদ্ভব ঠাকরের নেতৃত্বাদীন বিজেপি জোট করেছে মহারাষ্ট্রের বর্ষীয়ান নেতা শারদ পাওয়ারের নেতৃত্বাধীন এনসিপির সঙ্গে। এদিকে, এনসিপির একাংশ আবার শারদ পাওয়ারের ভাতিজা অজিত পাওয়ারের নেতৃত্বে দল থেকে বেরিয়ে বিজেপি-একনাথ জোটে যোগ দিয়েছে।
ফলে ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভোটের যে হিসেব হয়েছিল, তা এবারের নির্বাচনে তেমন কাজ করবে না। ভারতের সবচেয়ে ধনী রাজ্য মহারাষ্ট্র দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, এ নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আগের নির্বাচনের ফলাফল ধরে রাখা।
ওড়িশা
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওড়িশায় লোকসভা আসন রয়েছে ২১টি। ২০১৯ সালের নির্বাচনে এই ২১টি আসনের মধ্যে ১২টিতে জয়ী হয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবীন পাটনায়েকের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল বিজু জনতা দল (বিজেডি)। বিজেপি জিতেছিল ৮ টি আসনে। তার আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি জয় পেয়েছিল মাত্র একটি আসনে।
প্রসঙ্গত, এবারের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল বিজেডির; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর তা হয়নি।পশ্চিমবঙ্গের মতো ওড়িশাও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিজেপির কাছে। এবারের নির্বাচনের আগে রাজ্যটিতে বেশ কয়েকবার সফর করেছেন নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ।
বিহার
ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যেসব রাজ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেসবের তালিকায় বিহারের নাম বেশ ওপরের দিকে। পূর্বাঞ্চলীয় এই রাজ্যটিতে লোকসভার আসন রয়েছে ৪০টি। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ৩৯টি আসনে জয় পায়। বিহারে এনডিএ জোটের দু’টি দল সক্রিয়—বিজেপি এবং জেডিইউ। জেডিইউয়ের প্রেসিডেন্ট নীতিশ কুমার বিহারের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী।
তবে ২০১৯ সালের নির্বাচনের কয়েক মাস পরেই বিজেপি এবং জেডিইউয়ের মধ্যে ফাটল ধরে এবং এনডিএ জোট ছেড়ে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আরজেডি’র সঙ্গে জোট করেন নীতিশ কুমার। ২০২৩ সালে অবশ্য আরজেডিকে ত্যাগ করে ফের বিজেপি জোটে ফিরে এসেছেন তিনি।
এবারের নির্বাচনে বিহারে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের মূল নেতা নীতিশ কুমার। অন্যদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের বৃহত্তম দল আরজেডির নেতৃত্বে রয়েছেন বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদবের ভাতিজা তেজস্বী যাদব। এছাড়া বিকাশশীল ইনসান পার্টি, সিপিআই, সিপিএম এবং সিপিআই-এমএল।
এবারের নির্বাচনে নিজেদের হারানো আসনগুলো ফিরে পেতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে আরজেডি এবং ইন্ডিয়া। নির্বাচনের সময় এবং তার আগে বিভিন্ন জনসভা ও প্রচার-প্রচারণায় একসঙ্গে ছিলেন তেজস্বী যাদব এবং রাহুল গান্ধী।
তেলেঙ্গানা
দক্ষিণ ভারতের এই রাজ্যটিতে লোকসভা আসন রয়েছে ১৭টি। ২০১৯ সালের নির্বাচনে এই ১৭টি আসনের মধ্যে ৯টিতে জয়ী হয়েছিল তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেকর রাও’র নেতৃত্বাধীন ভারত রাষ্ট্র সমিতি (বিআরএস)। বাকি আসনগুলোর মধ্যে বিজেপি জিতেছিল ৪টিতে এবং কংগ্রেস ৪টিতে।
এবারের নির্বাচনে কংগ্রেস ও বিজেপি উভয় দলের তেলেঙ্গানা শাখার নেতাদের মূল লক্ষ্য বিআরএসের আসনগুলো দখল করা। এনডিএ বা ‘ইনডিয়া’— কোনো জোটেই নেই বিআরএস। তাই দলটির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিজেদের আগের অর্জন ধরে রাখা।
কর্ণাটক
তেলেঙ্গানার পাশপাশি দক্ষিণ ভারতের অপর যে রাজ্যে বিজেপি-কংগ্রেসের ‘ইজ্জতের লড়াই’ (প্রেস্টিজ ফাইট) চলছে, তার নাম কর্ণাটক। রাজ্যটিতে লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে ২৮টি। ২০১৯ সালের নির্বাচনে এসব কেন্দ্রের মধ্যে ২৬টিতে জয় পায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। কর্ণাটকের স্থানীয় রাজনৈতিক দল জেডিএস এবং কংগ্রেস জিতে একটি করে আসন।
সেই নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ছিল জেডিএসের। তবে এবারের নির্বাচনে দলটি বিজেপির নেততৃাধীন এনডিএ জোটে যোগ দিয়েছে। এই রাজ্যটির দিকে বিজেপি এবং কংগ্রেস— উভয় দলই এই রাজ্যটিকে ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ দক্ষিণ ভারতে একমাত্র এই রাজ্যটিতে সাংগঠনিকভাবে খানিকটা শক্তিশালী বিজেপি। তাই ২০১৯ সালের নির্বাচনের অর্জন ধরে রাখতে স্বাভাবিকভাবেই তৎপর এনডিএ জোট।
এদিকে ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে কর্ণাটকের রাজ্য সরকারে ক্ষমতাসীন হয়েছে কংগ্রেস। কর্ণাটক কংগ্রেসের পুরোনো ঘাঁটি এবং রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারমাইয়া কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা। তাই নিজেদের পুরনো ঘাঁটি উদ্ধারে মরিয়া কংগ্রেসও।
অন্ধ্র
দক্ষিণ ভারতের আরেক রাজ্য অন্ধ্রে লোকসভার আসন ২৫টি। রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এন চন্দ্রবাবু নাইডুর রাজনৈতিক দল টিডিপি বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের সদস্য। এবারের নির্বাচনে রাজ্যের ২৫টি আসনের মধ্যে ১৭টিতে টিডিপি, ৬টিতে বিজেপি এবং বাকি দুই আসনে অভিনেতা থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া পবন কল্যাণের জনসেনা পার্টি প্রার্থী দিয়েছে।
অন্যদিকে রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এবং ওয়াইসিআর কংগ্রেসের নেতা জগমোহন রেড্ডি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের সদস্য। ২০১৯ সালে নির্বাচনে ওয়াইসিআর কংগ্রেস এবং কংগ্রেস জোট রাজ্যের ২২টি আসনে জয় পায়, টিডিপি জয়ী হয় মাত্র ৩টি আসনে। এবারের নির্বাচনে রাজ্যে আরও বেশি আসনের আশা করছে বিজেপি-টিডিপি জোট।