১৪ বছর পরে ক্ষমতার পালাবদলের বার্তা নিয়ে বৃহস্পতিবার ভোটপর্ব শুরু হল যুক্তরাজ্যে। জনমত সমীক্ষার ফল সত্যি হলে, প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টির (টোরি) দ্বিগুণ ভোট এবং তিন গুণ আসন নিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চলেছে কিয়ার স্টার্মারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘হাউস অফ কমন্স’-এ মোট আসন ৬৫০। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ‘জাদু সংখ্যা’ ৩২৬। ‘দ্য গার্ডিয়ান’-সহ বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম এবং জনমত সমীক্ষার পূর্বাভাস, লেবার পার্টি এ বার ৪০০-র বেশি আসন পেয়ে ১৪ বছরের কনজারভেটিভ শাসনের ইতি টানতে চলেছে।
বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় (বাংলাদেশি সময় বেলা ১২টা) শুরু হবে ভোটগ্রহণ। চলবে রাত ১০টা পর্যন্ত। তার পরেই শুরু হবে গণনা। রাত ১২টায় প্রকাশিত হবে প্রথম ফল। তার পরের ফল প্রকাশিত হবে যথাক্রমে রাত ৩টা, ভোর ৪টা, ভোর ৫টা এবং সকাল ৭টায়। শুক্রবার সকালেই স্পষ্ট হয়ে যাবে আগামী ৫ বছরের জন্য ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের বাসিন্দা কে হতে চলেছেন।
৪৪ বছর বয়সি ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কনজারভেটিভরা ১০০-র নীচে নেমে শতাব্দীর সবচেয়ে খারাপ ফল করতে পারে বলেও পূর্বাভাস মিলেছে বিভিন্ন জনমত সমীক্ষায়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফের একটি জরিপের ওপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণে বলা হয়, হাউজ অব কমন্সে বর্তমানে যাদের ৩৬৫ আসন রয়েছে, ক্ষমতাসীন দল হয়েও তারা এবার মাত্র ৫৩ আসন পাবে। পার্লামেন্টের ৬৫০ আসনের মধ্যে লেবার পার্টি পাবে ৫১৬ আসন। এমনকি নিজের আসন নর্থ ইয়র্কশায়ারের রিচমন্ডে তার ‘শক্ত ঘাঁটিতে’ও হেরে যেতে পারেন ঋষি সুনাক, বলেও কয়েকটি সমীক্ষার ইঙ্গিত রয়েছে!
আরও বেশকিছু গণমাধ্যমের অনুমানে বলা হয়, বৃহত্তম দলের স্থানও হারাতে চলছে কনজারভেটিভ পার্টি। এমনকি লিবারেল ডেমোক্র্যাটদেরও তাদের চেয়ে বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এমন অনুমান যে বাতাসে বেরিয়ে আসছে না, তাও স্পষ্ট করেছে কয়েকটি গণমাধ্যম। বেশকিছু কারণও তুলে ধরেছে সংবাদ মাধ্যমগুলো। ২০১০ সালে যখন ডেভিড ক্যামরুনের হাত ধরে টোরিরা ক্ষমতায় আসেন; এরপর থেকেই দেখা দেয় অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মহামারি ও ব্রেক্সিটের মতো নানা সংকট।
জনমত সমীক্ষা বলছে, লেবার পার্টি ৪০ শতাংশ ভোট পাবে, টোরিরা পাবে ২০ শতাংশ ও নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বাধীন কট্টরপন্থী দল রিফর্ম ইউকে পাবে ১৬ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ, ভোট কেটে টোরিদের বড় ক্ষতি করতে চলেছে রিফর্মিস্টরা। ইঙ্গিত মিলেছে, গত বার টোরিদের ভোট দেওয়া এক-তৃতীয়াংশ ব্রিটিশ নাগরিকের ভোট এ বার কট্টর অভিবাসন বিরোধী রিফর্ম ইউকে পেতে চলেছে। প্রসঙ্গত, ব্রিটেনে এ বারের নির্বাচনে মোট ৪৫১৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির আসনও এ বার অন্তত তিন গুণ বেড়ে ৪০ ছুঁতে পারে বলে ইঙ্গিত রয়েছে বিভিন্ন সমীক্ষায়। লড়াইয়ে রয়েছে গ্রিন পার্টি, রিফর্ম পার্টি, স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি-সহ ছোট–বড় প্রায় ৯৮টি রাজনৈতিক দল এবং নির্দলেরাও। ইতিহাস বলছে, ব্রিটেনেও বিভিন্ন জনমত সমীক্ষার ফল অতীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্র, জটিল এবং মিশ্র জনবিন্যাস, প্রধান শত্রুকে হারাতে ‘ট্যাকটিক্যাল ভোট’— এ সবই নানা ভাবে কঠিন করে তোলে নির্বাচনী ফলাফলের অনুমান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০৮ সালের পর অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে বেরোতে পারেনি যুক্তরাজ্য। কনজারভেটিভ পার্টির শাসনমালে যুক্তরাজ্যে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে; বেড়েছে স্বাস্থ্য খাতেও। এছাড়া নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও বাড়েনি মানুষের আয়। এরই মধ্যে বুধবার (৩ জুলাই) প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক একটি বিদ্যালয় পরিদর্শনের সময় বলেন, লেবার পার্টির অভাবনীয় জয়ের ধারণা করা হলেও নির্বাচনের ফলাফলে ভারসাম্য থাকবে। তার দল লেবার পার্টির কাছে কখনোই আত্মসমর্পণ করবে না বলেও জানান ঋষি সুনাক।
বিপর্যস্ত সুনাক জনপ্রিয় নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, দলের অভ্যন্তরীণ ব্যালটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন। তার নেতৃত্বে টোরিরা এখন শুধু লেবার পার্টির বিরুদ্ধে হেরে যাওয়ার লড়াই করছে না, একই সঙ্গে উদীয়মান রিফর্ম ইউকে পার্টি যে ক্ষতি করছে, তা ঠেকাতেও লড়ছে। এ দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন নাইজেল ফারাজ, তিনি জাতীয়তাবাদী এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সমর্থক হিসেবে বেশি পরিচিত।
সঙ্কটের এই সময়ে শেষবেলার প্রচারে সুনাক পাশে পেয়েছেন কনজারভেটিভ পার্টির অন্দরে তার ‘কট্টর সমালোচক’ হিসাবে পরিচিত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে। বুধবার লন্ডনে দলীয় প্রচারসভায় জনসন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, লেবাররা ‘বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ পেয়ে গেলে বিপন্ন হয়ে পড়বে ব্রিটেনের গণতন্ত্র। যদিও ভোটের আগেই কার্যত হার স্বীকার করে নিয়েছেন প্রাক্তন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যান। সংবাদপত্রে লেখা নিবন্ধে তার মন্তব্য— ‘‘আমাদের এখন বিরোধী আসনে বসার সময় হয়ে গিয়েছে।’’ একই সুর সুনকের দল টোরি পার্টির প্রবীণ নেতা, ওয়ার্ক অ্যান্ড পেনশনস দফতরের সচিব মেল স্ট্রাইডের গলাতেও।
ব্রেক্সিট–পরবর্তী সময় থেকে ভঙ্গুর অর্থনীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, অভিবাসন সমস্যা-সহ সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ব্রিটেনের জনগণ বিরক্ত বলে জনমত সমীক্ষাগুলির ইঙ্গিত। তা ছাড়া টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বের প্রতিও রয়েছে ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী ক্ষোভ’। পাশাপাশি, গত পাঁচ বছর টোরিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, তিন বার প্রধানমন্ত্রী বদলের প্রভাবও পড়তে পারে ভোটে।
অন্য দিকে, লেবারদের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে তাদের অ-শেতাঙ্গ ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন। স্টার্মার গাজা হামলায় ইসরায়েলকে সমর্থন এবং অভিবাসন বিরোধী কড়া অবস্থান প্রকাশ করে সেই পথ প্রশস্ত করেছেন ইতিমধ্যেই। যে কারণে গত এক বছরে লেবার পার্টির সদস্যসংখ্যা কমেছে দু’লক্ষের বেশি! যা প্রায় ৪০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে অভিবাসী ভোটের একটি অংশ ওয়ার্কার্স পার্টির দিকে যেতে পারে বলে কয়েকটি সমীক্ষার ইঙ্গিত।