ঢাকা | বঙ্গাব্দ

যুদ্ধের মধ্যেও ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল

চরমপন্থী বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে একজন মোশে শারভিত বন্দুকের মুখে হুমকি দিয়ে ওই অঞ্চলের বাসিন্দা আয়েশার বাড়ি কেড়ে নেন।
  • | ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
যুদ্ধের মধ্যেও ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল ১১ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে বসতি স্থাপনকারীদের হাতে।

গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই অধিকৃত পশ্চিমতীরে দ্রুত অবৈধ বসতি স্থাপন করছে ইহুদিরা। যুদ্ধের আড়ালে ফিলিস্তিনিদের বসতি কেড়ে নিয়ে নতুন করে ইহুদি বসতি স্থাপন বা ‘সেটলমেন্ট’-এর অনুমোদন দিয়েছে ইসরায়েল। এই নতুন বসতির জন্য কেড়ে নেয়া হয়েছে বহু মানুষের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি। শুধু তাই নয়, অনুমোদন ছাড়াই নতুন ইসরায়েলি ফাঁড়িও স্থাপন করা হয়েছে। খবর বিবিসির।

যাদের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি এই নতুন বসতি স্থাপনের জন্য কেড়ে নেয়া হয়েছে তাদের তালিকায় রয়েছে আয়েশা শাতায়েহ। তিনি সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, একজন ব্যক্তি তার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তার ৫০ বছর ধরে বসবাস করা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে। ২০২১ সালে অধিকৃত পশ্চিম তীরে তার বাড়ির কাছে একটি অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের ফাঁড়ি স্থাপনের পরে তাকে সশস্ত্র হুমকি, হয়রানি ও ভয় দেখানো শুরু হয়।

বিবিসির নতুন বিশ্লেষণ দেখা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বসতি দখল করে ইসরায়েল বাহিনীর এই অবৈধ ফাঁড়ির সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। বর্তমানে পশ্চিমতীরে কমপক্ষে ১৯৬টি ইসরায়েলের ফাঁড়ি রয়েছে, যার ২৯টি গত বছর স্থাপন করা হয়েছে। স্থাপিত এসব ফাঁড়ি ইসরায়েলি এবং আন্তর্জাতিক আইন উভয়ের অধীনে অবৈধ হলেও ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত সংস্থাগুলো নতুন অবৈধ ফাঁড়ি স্থাপনের জন্য অর্থ এবং জমি সরবরাহ করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফাঁড়িগুলো বসতি স্থাপনের চেয়ে বেশি দ্রুত ভূমি দখল করছে এবং একইসঙ্গে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহিংসতা ও হয়রানিমূলক আচরণ ক্রমবর্ধমানভাবে বৃদ্ধি করছে। ফাঁড়ির সংখ্যার সরকারি পরিসংখ্যান নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এ জাতীয় ‘সেটলমেন্ট’কে অবৈধ হিসেবে দেখা হয়। যদিও এই বিষয়ে ইসরায়েল সহমত পোষণ করে না।

কিন্তু বিবিসি তাদের অবস্থানের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখেছে দখলকৃত পশ্চিমতীরের ফাঁড়িগুলো এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৯৬টি ফাঁড়ির প্রায় অর্ধেক, যার সংখ্যা ৮৯টি ২০১৯ সাল থেকে তৈরি করা হয়েছে। এই ফাঁড়িগুলোর মধ্যে কয়েকটি পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত।

পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক সাবেক কমান্ডার আভি মিজরাহি বলেছেন, বেশিরভাগ বসতি স্থাপনকারী আইন মেনে চলা ইসরায়েলি নাগরিক। তবে তিনি স্বীকার করেছেন ফাঁড়ির কারণে সহিংসতা বেড়েছে। তিনি বলেন, যখনই এলাকায় অবৈধভাবে ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়, এটি ওই এলাকায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়।

চরমপন্থী বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে একজন মোশে শারভিত বন্দুকের মুখে হুমকি দিয়ে ওই অঞ্চলের বাসিন্দা আয়েশার বাড়ি কেড়ে নেন। তিনি আয়েশার বাড়ি থেকে ৮০০ মিটারেরও কম দূরত্বে ফাঁড়ি স্থাপন করেন, যা গত মার্চে মার্কিন সরকার অনুমতি দেয়। এই ফাঁড়ি থেকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানো অভিযোগ পাওয়া গেছে। আয়েশা জানান, মোশে শারভিত আমাদের জীবনকে নরক বানিয়ে ফেলেছেন। এখন তাকে বাড়ি ছেড়ে তার ছেলের সঙ্গে কাছাকাছি একটি শহরে থাকতে হবে।

পশ্চিমতীরের কিছু অংশে একচেটিয়াভাবে প্রতিষ্ঠিত ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যেই বাস করছে এই নতুন বসতি স্থাপনকারীরা। এর মধ্যে অনেক বসতিতেই ইসরায়েলি সরকারের আইনি সমর্থন রয়েছে। অন্য বসতি যা ‘আউট পোস্ট’ বা ফাঁড়ি হিসাবে পরিচিত সেগুলো বেশিরভাগই কাফেলা এবং লোহার তৈরি ছাউনির মতো। এগুলো কিন্তু ইসরায়েলের আইনের চোখেও অবৈধ। কিন্তু চরমপন্থীরা আরো বেশি জমি দখলের করার উদ্দেশ্য নিয়ে এগুলো তৈরি করে।

জুলাই মাসে, যখন জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত প্রথমবার জানতে পারে পূর্ব জেরুজালেম-সহ পশ্চিমতীরে ইসরায়েলের দখল অবৈধ, তখন ওই দেশকে বসতি স্থাপন সংক্রান্ত সব কার্যকলাপ বন্ধ এবং যত দ্রুত সম্ভব সেনা প্রত্যাহার করতে কথা বলা হয়।

ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্ররা কিন্তু বারবার এই বসতি স্থাপনকে শান্তি আনার পথে অন্তরায় বলে আখ্যা দিয়ে এসেছে। ইসরায়েল অবশ্য এই নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দেয় –ইহুদিরা তাদের নিজেদের জমিতে কোনো ভাবেই দখলদার নয়। পশ্চিমতীরে বসবাসকারী অনেক বসতি স্থাপনকারী দাবি করেন যে, ইহুদি হিসাবে, তাদের জমির সঙ্গে ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে, পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের এই পদক্ষেপকে যাতে কোনো ভাবেই বন্ধ না করা যায়, তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে চরমপন্থীরা।

ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে উগ্র ডানপন্থী সরকারের সমর্থন পেয়ে ওই অঞ্চলে দ্রুত তাদের নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করেছে। পশ্চিম তীরে সংযুক্তির পরিকল্পনাকে আরো মজবুত করছে এই চরমপন্থীরা। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে গাজায় বসতি স্থাপনের জন্য প্রকাশ্যে আহ্বানও জানাচ্ছে। নতুন বসতি স্থাপনকারীদের অনেকেই এখন ইসরায়েল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত।

ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা বেটসেলেমের তথ্য অনুযায়ী, একই সময়ে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের কারণে অন্তত পশ্চিম তীরের ১৮টা গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েল ও জর্ডনের মধ্যবর্তী এই ফিলিস্তিনি অঞ্চল ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে সময় দখল করে ইসরায়েল। তখন থেকে এই অংশ তাদের দখলেই রয়েছে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সাতই অক্টোবর থেকে চলতি বছরের আগস্ট মাসের মধ্যে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ৫৮৯ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৫৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে ইসরায়েলির বাহিনীর হাতে এবং অন্তত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে বসতি স্থাপনকারীদের হাতে। জাতিসংঘের মতে, এদের মধ্যে কেউ কেউ হামলার পরিকল্পনা করছিল বলে জানা গিয়েছে, আবার এই তালিকায় নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনও রয়েছে। আবার অন্য দিকে, ওই একই সময়ে ফিলিস্তিনিরা পাঁচজন ‘সেটলার’ বা বসতি স্থাপনকারী ও ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর নয়জন সদস্যকে হত্যা করেছে।

চলতি সপ্তাহে বেথেলহেমের কাছে ওয়াদি আল-রাহেলে বসতি স্থাপনকারী ও ইসরায়েলি সেনারা প্রবেশ করে। সেখানে ৪০ বছরের এক ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, এর আগেও কাছাকাছি থাকা একটা ইসরায়েলি গাড়ি লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া হয়।

আগস্ট মাসে জিট গ্রামে জায়গা দখলের উদ্দেশ্যে ঢুকে পড়া কয়েক ডজন লোক তাণ্ডব চালালে ২২ বছরের এক ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক স্তরে নিন্দা করা হয়। ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী এই ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছ। তাদের পক্ষ থেকে একে ‘মারাত্মক সন্ত্রাসী ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এই পদক্ষেপ ‘দায়মুক্ত’ করার জন্য বলেই মনে করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

ইসরায়েলি নাগরিক অধিকার গোষ্ঠী 'ইয়েশ দিন' এর তথ্য বলছে ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার ঘটনার আনুষ্ঠানিক তদন্তের পর মাত্র ৩ শতাংশ ইহুদি দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। ইসরায়েলি গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়া রোনেন বারের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘লঘু আইনি পদক্ষেপই’ চরমপন্থী দখলদারদের ‘উৎসাহ’ দিচ্ছে।