যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ এক বিশেষ গুরুত্ববহ ব্যবস্থা। এই পদ্ধতির মাধ্যমেই দেশটির প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এই ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন পদ্ধতির তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন, যা মার্কিন সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি কী?
ইলেক্টোরাল কলেজ হচ্ছে একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের পাশাপাশি বিশেষ প্রতিনিধিদের ভোটের মাধ্যমেও নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হয়। মূলত, এই পদ্ধতির মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন না করে প্রভাবশালী ‘ইলেক্টরদের’ নির্বাচিত করে ভোটাররা, যারা পরে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে ভোট দেন। এই পদ্ধতির মূলে আছে ৫৩৮ জন ইলেক্টর, এবং প্রেসিডেন্ট হতে হলে প্রার্থীকে প্রয়োজন হয় ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট।
ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতির মূল কাঠামো
ইলেক্টোরাল কলেজের ইলেক্টরের সংখ্যা প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। এতে রয়েছে:
১. প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের কংগ্রেস সদস্যের সংখ্যা: সিনেট (প্রতিটি অঙ্গরাজ্য থেকে ২ জন) এবং হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে প্রতিনিধিদের সংখ্যা নির্ধারিত করে।
২. ওয়াশিংটন, ডি.সি.: কোনো অঙ্গরাজ্য নয় হওয়া সত্ত্বেও, এই রাজধানী এলাকাকে তিনটি ইলেক্টোরাল ভোট দেওয়া হয়।
অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইলেক্টোরাল ভোটের সংখ্যা নির্ধারিত হয়, তাই বৃহৎ জনসংখ্যার রাজ্যগুলোতে ইলেক্টোরাল কলেজে ভোটের সংখ্যা বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ক্যালিফোর্নিয়ায় ইলেক্টোরাল ভোট ৫৫টি, যা দেশের যেকোনো অঙ্গরাজ্যের তুলনায় সর্বোচ্চ।
ইলেক্টোরাল ভোটের কাজ করার পদ্ধতি
যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নির্বাচনে জনগণ জনপ্রিয় ভোট প্রদান করেন, যা আসলে ইলেক্টরদের ভোট দেওয়ার পথ খুলে দেয়।
পদ্ধতিটি কীভাবে কাজ করে:
১. জনপ্রিয় ভোট: সাধারণ নির্বাচনে জনগণ যে প্রার্থীকে ভোট দেন, সেই ভোট অনুসারে অঙ্গরাজ্যগুলো ইলেক্টর নিয়োগ করে। এই ইলেক্টররা যে দলের হয়ে নির্বাচনে জয়ী হন, সেই দলের প্রার্থী ইলেক্টোরাল ভোটে অঙ্গরাজ্যের সমর্থন পান।
২. উইনার-টেকস-অল নিয়ম: প্রায় সব অঙ্গরাজ্যই উইনার-টেকস-অল নিয়ম মেনে চলে, যার মানে একটি অঙ্গরাজ্যে যে প্রার্থী জনপ্রিয় ভোটে জয়ী হন, তিনিই পুরো রাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোট পান। শুধু নেব্রাস্কা ও মেইন রাজ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে যেখানে জনপ্রিয় ভোটের ভিত্তিতে কিছু ভোট বিভাজন হয়।
৩. ইলেক্টরদের ভোট প্রদান: নির্বাচনের পর ইলেক্টররা নির্দিষ্ট তারিখে একত্রিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন। এটি ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের দিকে অনুষ্ঠিত হয়।
৪. কংগ্রেসে ভোট গণনা: ইলেক্টোরাল ভোটের আনুষ্ঠানিক গণনা হয় কংগ্রেসে, যেখানে নির্দিষ্ট সংখ্যক ইলেক্টোরাল ভোট প্রাপ্ত প্রার্থীকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়।
ইলেক্টোরাল কলেজের সুবিধা ও সমালোচনা
সুবিধা:
- ইলেক্টোরাল কলেজ ব্যবস্থা অঞ্চলভিত্তিক ভারসাম্য নিশ্চিত করে, যাতে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের জনমতের গুরুত্ব থাকে।
- এটি বড় রাজ্যের প্রভাব প্রতিহত করে এবং ছোট রাজ্যগুলোও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।
সমালোচনা:
- এই পদ্ধতিতে কখনো কখনো জনপ্রিয় ভোটের চেয়ে কম ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী ইলেক্টোরাল ভোটে জয়ী হন।
- এতে সরাসরি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন নাও হতে পারে।
ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি কয়েকবার বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, তবে এটি সংবিধান রক্ষার অঙ্গীকার হিসেবে গণ্য হয়। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের জনমতের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে শুধুমাত্র বৃহৎ রাজ্যের উপর নির্ভরশীল না রাখা ইলেক্টোরাল কলেজের প্রধান উদ্দেশ্য।
এই পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কারণে ভোটাররা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে ‘ইলেক্টর’ বেছে নিয়ে, নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে সক্ষম হন। বাংলাদেশের অভিবাসীদের জন্যও এই পদ্ধতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অভিবাসী এলাকাগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান, গুরুত্ব এবং সামাজিক অবদান স্বীকৃতি পায়।
এই পদ্ধতি এমন এক জটিল প্রক্রিয়া হলেও, এটি মার্কিন গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি।